• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
কঠোর লকডাউনে প্রস্তুত সরকার

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

কঠোর লকডাউনে প্রস্তুত সরকার

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১২ এপ্রিল ২০২১

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের লাগাম টানতে আগামী বুধবার থেকে ‘কঠোর লকডাউনে’ যাচ্ছে সরকার। এই লকডাউনে সাধারণ মানুষ ইচ্ছে হলেই ঘরের বাইরে বের হতে পারবেন না। শুধু জরুরি প্রয়োজনই বাইরে বের হওয়া যাবে। এমন ‘লকডাউন’ সফল করতে এরই মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সরকার। গতবারের মতো ৬৪ জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ৬৪ সচিবকে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিজ নিজ জেলার রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করবেন।

এই ‘লকডাউনে’ শুধু জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। হাসপাতাল, গণমাধ্যম, ফায়ার সার্ভিস, মানুষ ও প্রাণীর খাদ্যপণ্য সরবরাহকারী যানবাহন নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হবে। আর কাঁচাবাজার ও নিত্যপণ্যের দোকান খোলা থাকবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ওষুধের দোকানও খোলা রাখা যাবে। ব্যাংকও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা থাকবে।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এরপর মেয়াদ বাড়িয়ে ৬৬ দিন করা হয়েছিল। এবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় গত ২৯ মার্চ যে ১৮ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়, সেটি কার্যত কোনো ফল দেয়নি। এই কঠোর বিধি-নিষেধ নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, যে কারণে দুই দফায় সেই বিধি-নিষেধ শিথিল করে সরকার। এরপর আগামী বুধবার অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল থেকে ‘সর্বাত্মক লকডাউনের’ ঘোষণা দেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তারা বলছেন, কঠোর বিধি-নিষেধ নিশ্চিত করতে সাধারণ ছুটির বিকল্প নেই। প্রথমবার সাধারণ ছুটি দেওয়ার কারণেই করোনা সংক্রমণ সহজে নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল। তবে কিছু যৌক্তিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির যানবাহন চলাচল নিশ্চিত থাকবে।

কী কী খোলা থাকতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে একজন কর্মকর্তা জানান, বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। এই সময়ে অনেক এলাকা থেকে কৃষি শ্রমিকরা হাওর অঞ্চলে ধান কাটতে যান। এমন শ্রমিকদের জন্য দূরপাল্লার বিশেষ বাস নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। এভাবে দেশের মানুষের জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ছাড় থাকবে।

এদিকে গতকাল রোববার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তার সরকারি বাসভবন থেকে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনে জরুরি সেবা ছাড়া সবাইকে বৃহত্তর স্বার্থে ঘরে থাকার জন্য আহ্বান জানান । একই সাথে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকবে বলেও তিনি জানান।

তিনি জানান, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে শেখ হাসিনা সরকার সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। এর ধারাবাহিকতায় সরকার লকডাউন ঘোষণা করে। ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউন। এ সময় জরুরি সেবা ছাড়া সবাইকে ঘরে অবস্থান করতে হবে আমাদের বৃহত্তর স্বার্থে। চলমান লকডাউন ১১ এপ্রিল শেষ হবে। কিন্তু ১২ ও ১৩ এপ্রিল প্রথম ধাপের বা চলমান লকডাউনের ধারাবাহিকতা চলবে।

তিনি বলেন, আজ সোমবার এবং মঙ্গলবার শুধু দেশের সিটি করপোরেশন এলাকায় শর্তসাপেক্ষে সমন্বিত ভাড়ার অর্ধেক আসন খালি রেখে গণপরিবহন চলবে এবং দূরপাল্লার যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত।

দেশের মানুষকে এই সংকটকালে ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়ে কাদের বলেন, স্বাস্থ্যবিধির প্রতি সামান্য অবহেলা আমাদের চিরচেনা জীবন থেকে ছিটকে দিতে পারে। হয়ে যেতে পারে পরিবার-পরিজন আত্মীয়স্বজনের এই মায়াময় পৃথিবী অচেনা। জীবনের পাশাপাশি জীবিকার চাকা সচল রাখতে আমাদের আস্থার ঠিকানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আস্থা রাখুন, ভরসা রাখুন স্রস্টার প্রতি। সবার প্রচেষ্টা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিশ্চয়ই এ মহামারী থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে আবারো ফিরবে পৃথিবী নিজ রূপে।

দূরপাল্লার বাস বন্ধই থাকছে : ৪ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা জারির পর দুই দফায় সেটি শিথিল করা হয়েছে। এর মধ্যে নগরে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালু রাখার সিদ্ধান্ত অন্যতম। কিন্তু দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। ১৪ এপ্রিল ‘কঠোর লকডাউন’ কার্যকরের আগে আজ সোমবার ও পরশু মঙ্গলবার দূরপাল্লার বাস চলবে না।

প্রতি জেলায় সচিবদের দায়িত্ব : করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য সরকারি কার্যক্রম সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য জ্যেষ্ঠ সচিব, সচিব ও সচিব পদমর্যাদার ৬৪ কর্মকর্তাকে ৬৪ জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস স্বাক্ষরিত এই নির্দেশনা সংশ্লিষ্ট সচিবদের কাছে পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা সমন্বয় কাজে তার মন্ত্রণালয় বা সংস্থার উপযুক্তসংখ্যক কর্মকর্তাকে সম্পৃক্ত করতে পারবেন। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করে কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

এবার হার্ডলাইনে যাবে পুলিশ : বুধবার থেকে শুরু হতে যাওয়া ‘লকডাউনে’ হার্ডলাইনে যাবে পুলিশ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঘরের বাইরে আসতে দেওয়া হবে না। যে-কোনো মূল্যে ঘরে থাকতে বাধ্য করবে পুলিশ।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, সরকারের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে লকডাউনের ঘোষণা দেওয়া হলেও লকডাউনের আওতাগুলো এখনো বর্ণনা করা হয়নি। নির্দেশনা পাওয়ার পর সেগুলো কার্যকরে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে পুলিশ।

ডিএমপির একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, সরকার ঘোষিত (চলমান) কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পুলিশ মূলত সচেতনতা সৃষ্টি ও মাস্ক বিতরণের কাজ করেছে। এ ছাড়া যারা অকারণে যানবাহন নিয়ে ঘোরাঘুরি করেছে তাদের ট্রাফিক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। তবে পরবর্তী লকডাউন বাস্তবায়নে পুলিশ আগের চেয়ে আরো বেশি সক্রিয় ও কঠোর থাকবে। যারা ঠুনকো অজুহাতে বাড়ির বাইরে বের হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশ জানায়, সড়কপথ-নৌপথে অবস্থানসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ বিনোদনকেন্দ্র ও পার্কে যেন কেউ জড়ো হতে না পারে সে ক্ষেত্রে নজরদারি করা হবে। ঢাকার ভেতরে ও বিভিন্ন প্রবেশপথে পুলিশ চেক করবে। এ ছাড়া ঢাকার ভেতরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টেগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হবে। সড়কে চলাফেরা করা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ। কারণ সন্তোষজনক না হলে পুলিশ তাদের বাসায় পাঠাবে।

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সাল থেকেই করোনা প্রতিরোধে পুলিশ মাঠে আছে। পুলিশ সচেতনতা বাড়াতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ১৪ এপ্রিলের লকডাউনে যেসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হবে, পুলিশ সেগুলো বাস্তবায়ন করবে।

পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের একজন পুলিশ সুপার (এসপি) সমমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘একমাত্র অসাবধানতা ও উদাসীনতার কারণেই ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। একজনের জন্য আশপাশের মানুষ, সহকর্মীসহ পরিবারের লোকেরা আক্রান্ত হচ্ছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে লকডাউন বাস্তবায়নে নির্দেশনা দেওয়া আছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারি নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করবে পুলিশ।’

এদিকে লকডাউনের সরকারি নির্দেশনা মানাতে র‍্যাবও মাঠে থাকবে। র‍্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (এএসপি) ইমরান খান বলেন, দেশে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করা হলে র‍্যাব মাঠে থাকবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে। লকডাউনকে কেন্দ্র করে যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সেজন্য র‍্যাবের অভিযান চলবে।

তিনি বলেন, জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। এতে কাজ না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা হবে।

বন্ধ হতে পারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও : আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে সারা দেশে শুরু হচ্ছে কঠোর লকডাউন। এই লকডাউন চলাকালে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও বন্ধ হতে পারে বলে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

বেবিচক চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান বলেন, সরকার কঠোর লকডাউন দিলে আমাদেরও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দিতে হবে। যাত্রী যদি বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু রেখে লাভ কী? সরকার কমপ্লিট শাটডাউন দিলে আমরাও ভাবছি সব ফ্লাইট বন্ধ করে দেব। কারণ যাত্রীরা তো বিমানবন্দরে আসতে পারবেন না। তারপরও লকডাউনের প্রজ্ঞাপন দেখি কী ধরনের বিধি-নিষেধ থাকে।

যদি আন্তঃজেলা পরিবহন না চলে তাহলে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও বন্ধ থাকবে বলে জানান বেবিচক চেয়ারম্যান।

দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে গত ৩ এপ্রিল থেকে যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের সব দেশের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় বেবিচক। ইউরোপের দেশগুলো ছাড়াও আর্জেন্টিনা, বাহরাইন, ব্রাজিল, চিলি, জর্ডান, কুয়েত, লেবানন, পেরু, কাতার, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক ও উরুগুয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রয়েছে। কঠোর লকডাউনে সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধের দিকে যাচ্ছে সংস্থাটি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads