• মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জৈষ্ঠ ১৪২৮
হতাশ আইনজীবী-বিচারপ্রার্থীরা

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

হতাশ আইনজীবী-বিচারপ্রার্থীরা

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০২১

দেশে সবকিছু সচল থাকলেও এখনো বন্ধ রয়েছে সাধারণ বিচারিক কার্যক্রম। এমনকি মার্কেট এবং দোকানপাটে যখন মানুষের উপচেপড়া ভিড় তখন স্বাস্থ্যবিধির দোহাই দিয়ে কেবল উচ্চ আদালতে বন্ধ দিয়ে রাখা হয়েছে ভার্চুয়াল বিচার কার্যক্রম। এমনিতে গেলো বছর থেকে এ পর্যন্ত কয়েকদফা লকডাউন এবং বিধিনিষেধে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় উচ্চ ও নিম্নআদালতের কার্যক্রম। এতে বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রিতার ফাঁদে পড়ে জামিনযোগ্য অনেক মামলার আসামিও দীর্ঘদিন ধরে জেলের ঘানি টানছেন। পাশাপাশি মামলার জটও বাড়ছে ক্রমেই।

এদিকে, উচ্চ আদালতে স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও সীমিত আকারে নয়টি বেঞ্চে নির্দিষ্ট কিছু মামলা এবং রিট আবেদন সংক্রান্ত বিষয়ের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। একইভাবে নিম্নআদালতেও হাজতি আসামিদের জামিন শুনানি হলেও বেশিরভাগ মামলার কার্যক্রমই বন্ধ রয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ওয়ারেন্টভুক্ত অনেক আসামি। যারা আদালতে আত্মসমপর্ণের মাধ্যমে জামিন নিতে পারতেন। বিশেষ করে চেক জালিয়াতি মামলার আসামি।

আইনজীবী তামান্না আহমেদ এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘লকডাউনের মধ্যে উচ্চ আদালতের ১৯ নম্বর কোর্ট খোলার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর আজ আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। এভাবে কোনো কোর্ট খোলা হচ্ছে আবার বন্ধ করা হচ্ছে এভাবেই চলছে। আর একদিকে আমাদের এবং আসামিপক্ষের যেমনি ভোগান্তি এবং তেমনি ক্লায়েন্টরাও আমাদের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন। তারা মনে করছেন, যেহেতু আদালত খোলা সেহেতু শুনানি না হওয়ারতো কোনো কারণ নেই।’ এ নারী আইনজীবী আদালতের কার্যক্রম সীমিত আকারে খোলা রাখা নিয়ে হতাশা জানিয়ে বলেন, ‘এটি কি ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের বুঝে আসেনা। একদিকে মার্কেট শপিংমল, দোকানপাট সবই যখন খোলা তখন আদালতে ভার্চুয়াল কার্যক্রম অন্তত সচল রাখা যেতো।’

গাজীপুরের পানিশাইল এলাকার ফার্নিচার মিস্ত্রি ইয়াকুব আলী গতবছর এই সময়ে পুলিশের করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার হন। ইয়াকুবের স্ত্রী মিথ্যা মামলায় তার স্বামীকে ফাঁসানো হয়েছে। স্বামী আটকের পর আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকা ছেড়ে বাপের বাড়িতে যেতে হয়েছে তাকে। কিন্তু মামলা পরিচালনার জন্য তাকে প্রায়ই ঢাকা আসতে হয়। নিম্নআদালতে জামিন না হওয়ায় উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন তিনি। গত ৫ এপ্রিলের আগে তার স্বামীর শুনানির দিন ধার্য ছিলো।

ইয়াকুবের আইনজীবী জানান, এ ধরনের মামলায় অনায়েসেই তিনি জামিন পাবেন। দুর্ভাগ্যক্রমে একটি নথির অভাবে নির্দিষ্ট দিনে শুনানি করতে পারেননি। পরবর্তী শুনানির আগেই লকডাউনের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ায় শুনানি করতে পারেননি আইনজীবী। সেই থেকে এখন অব্দি ইয়াকুবের স্ত্রী আশায় আছেন ঈদের আগেই হয়তো আদালত খুলবে এবং তার স্বামী জামিন পাবেন। ইয়াকুবের স্ত্রীর মতো এমন অনেক ভুক্তভোগী আসামি এবং স্বজনরা আশায় ছিলেন ঈদের আগে জামিন পেয়ে পরিবারের সাথে ঈদ আনন্দ উদযাপন করার। কিন্তু সে আশায় এখন কেবল গুড়েবালি।

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমানের মতে, ‘যেহেতু সবকিছু খুলে দেওয়া হয়েছে সেখানে আদালতের ভার্চুয়াল কার্যক্রম বন্ধ রাখা যুক্তিযুক্ত না। বিশেষ করে জামিনযোগ্য যেসব মামলা আছে এবং সেগুলো ত্বরান্বিত করার জন্য উচ্চ আদালত ভার্চুয়ালি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারতো এবং করাটা বাঞ্ছনীয় ছিলো।’ ড. মিজানুর রহমানের মতে, ‘যেখানে মানুষের মানবাধিকারের এবং বিচার পাওয়ার স্বাধীনতার প্রশ্ন বিষয়টি জড়িত সেখানে এটিকে অবশ্যই গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিলো এবং এটি আমরা মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আশা করতেই পারি।’

এদিকে, এমনিতেই উচ্চ ও নিম্নআদালতে কয়েক লাখ মামলার জট। তার ওপর গেলো বছর করোনার প্রাদুর্ভাব ও লকডাউনে কয়েকমাস আদালত বন্ধ থাকায় মামলার পরিমাণ পাহাড়সম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই জট  খুলতেই আবারো লকডাউনের কারণে বিচারকাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বিচারপ্রার্থী এবং আইনজীবীদের মাঝে। আইনজীবীদের দাবি, অন্তত লকডাউনের মাঝে ভার্চুয়াল কোর্ট চলমান রাখা যেতো।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস কাজল বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘বিচারিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিচারপ্রার্থী এবং আইনজীবী উভয়েই সঙ্কটে পড়েছেন। তবে একেবারে বন্ধ না করে ভার্চুয়ালি কোর্টগুলো সচল রাখা যেতো।’

অ্যাডভোকেট কাজল আরো বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় হয়তো মাননীয় প্রধান বিচারপতি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে আমরা আশা করবো তিনি শিগগিরই বিচারিক কার্যক্রম চালুর অনুমতি দেবেন।’

এদিকে, গত ৩ এপ্রিল প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, করোনার মাঝেও ভারতের উচ্চ আদালতের কার্যক্রম সচল থাকার উদাহরণ দিয়ে ‘সাংবিধানিক আদালত বন্ধ থাকতে পারেনা’-মর্মে মন্তব্য করেন। তার এই বক্তব্যে আশান্বিত হয়েছিলেন উচ্চ আদালতের আইনজীবীরা। তবে শুধুমাত্র ‘অতি জরুরি’ বিষয় ছাড়া লকডাউনের মধ্যে আর কোনো মামলার শুনানি হবে না বলে সবশেষ সিদ্ধান্ত হয়। এতে হতাশ হয়ে মানববন্ধন করেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীরা। মানববন্ধনে হাইকোর্ট বিভাগে ৩৫ ভার্চুয়াল বেঞ্চ চালুর দাবি জানান তারা।

লকডাউনের কারণে বিচার কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়েও একই প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে নিম্নআদালতের বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের মাঝেও। তারা বলেন, এমনিতেই তাদের হাতে অনেক মামলা ঝুলে আছে। গেলো বছরের ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমরা। এখন আবার আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মামলার জট দীর্ঘ হবে। তারা বলেন, মামলাজটের কারণে একেকটি কোর্টে প্রতিদিন একজন বিচারককে শতাধিক মামলার শুনতে হয়। এতে না বিচারক ঠিকভাবে সময় দিতে পারেন আর না আইনজীবীরা ঠিকভাবে শুনানির সুযোগ পান। এর মাঝে আবার লকডাউনে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি চরমে পৌঁছবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মুসলেহ উদ্দীন জসিম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘গত বছর লকডাউনের আগে যারা জেলে ছিলো তারা এখনো জেলে আছে। এদের মধ্যে যাদের মামলা জামিনযোগ্য তারা জামিন বঞ্চিত হচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘এমনিতেই আমাদের বিচারকাজে একটি মনোভাব দাঁড়িয়ে গেছে যে, দোষী কিংবা নির্দোষ যেই হোক না কেন প্রথমবার সে জামিন পাবেনা। ফলে ওই বিচারপ্রার্থীকে পরবর্তী শুনানির জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয় না হলে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘অনেক মিথ্যা মামলার আসামিদেরকে করোনার কারণে এমনিতেই বিনা অপরাধে দীর্ঘদিন জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে। তারওপর এখন লকডাউনের কারণে তাদের জেলের ঘানি আরো দীর্ঘায়িত হলো। ফিজিক্যালি না হলেও আদালতগুলো অন্তত ভার্চুয়ালি সচল রাখা উচিত।’

ঈদের আগে শেষ পর্যন্ত আদালত না খোলার সিদ্ধান্তে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন ভুক্তভোগী সবপক্ষই। আইনজীবী মো. মনিরুজ্জামান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আসামির স্বজনরা প্রতিনিয়তই আমাদেরকে ফোন দিয়ে জানতে চাচ্ছেন কবে হবে শুনানি। কিন্তু আমরা তাদেরকে কোনো আশ্বাস দিতে পারছি না। এ সিদ্ধান্ত আইনজীবীদের বিপাকে ফেলে দিয়েছে।’

ঢাকা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবি সম্বলিত একটি দরখাস্ত প্রধান বিচারপতিকে দেওয়া হয়েছিলো। যেখানে আইনজীবীর মাধ্যমে মামলার হাজিরা, হাজতি আসামিদের হাজির না করা, সবধরনের স্থগিতাদেশ ও নিষেধাজ্ঞা ও জামিনের মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া, এজলাসে প্রবেশাধিকার সীমিত করে দেওয়া এবং আদালতের সামনে স্যানিটাইজার ও হাত ধোয়ারসামগ্রী রাখাসহ ১০ দফা দাবি জানানো হয়েছিলো। তবে আইনজীবী সমিতির দাবির এ প্রতিফলন অবশ্য সুপ্রিমকোর্টের সিদ্ধান্তে ঘটেনি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads