• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আসছে বিটুমিন

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আসছে বিটুমিন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৮ মে ২০২১

বিটুমিনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না কেউ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিটুমিন আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ। বিএসটিআই, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বুয়েটের মান পরীক্ষা ছাড়াই বিটুমিন আসছে দেশে। আর চট্টগ্রাম বন্দরে কাস্টমসের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে সেগুলো ছাড়পত্রও পেয়ে যাচ্ছে। এতে সড়কে জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, আমদানি করা বিটুমিন অবৈজ্ঞানিক উপায়ে রাখা হচ্ছে মাসের পর মাস। এ ছাড়া মুনাফার কৌশলে বিক্রি হচ্ছে হাতে হাতে। আর প্রতিবারই মিশছে ভেজাল। এদিকে উৎপাদন থেকে আমদানি পর্যন্ত কীভাবে অসাধু ব্যবসায়ীরা বিটুমিনের গুণগত মান নষ্ট করে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে আমদানি হয়ে আসা এসব নিম্নমানের বিটুমিন আবার সড়কে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে নির্ধারিত সময়সীমা পর্যন্ত সড়কগুলো টিকছে না। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আমদানিকারকদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে-আন্তর্জাতিক বাজারে যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে, তাদের কাছ থেকে সস্তায় বিটুমিন কেনা।

ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি-আইইউটি’র সহকারী অধ্যাপক আইইউটি এবং বিটুমিন বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুস সাকিব বলেন, এমন একটি শিপ বা জাহাজ থেকে বিটুমিন নেওয়া হচ্ছে, যেটি ৩ থেকে ৪ মাস সাগরে ভাসছে। সেখানেই শিপের পরিত্যক্ত তেল ও তেলজাতীয় ক্ষতিকর পদার্থ বিটুমিনে মেশানো হচ্ছে। এক কথায় বলতে গেলে চোরাই প্রক্রিয়ায় মানহীনভাবে তৈরি বিটুমিন বাংলাদেশে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই মানহীন ও রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ থাকায় ভেজাল বিটুমিনের দামও কিছুটা কম হয়। এই অল্প দামে পাওয়া খারাপ বিটুমিন সারা দেশের সড়কে নির্মাণে ব্যবহূত হচ্ছে। আসলে আবর্জনাকে আমরা রাস্তায় বিটুমিন হিসেবে ব্যবহার করছি।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই)-এর সভাপতি ও বিটুমিন আমদানিকারক মাহবুব আলম সম্প্রতি বলেন, আমরা চাই গুণগত মানসম্পন্ন বিটুমিন দেশে উৎপাদন হোক। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিটুমিন আমদানি করতে হচ্ছে। কিন্তু দেশে উৎপাদন হলে আমদানির প্রয়োজন নেই। একই সঙ্গে আমদানি উৎসাহিত করার কোনো সুযোগ এখানে নেই। বরং বিটুমিন রপ্তানিকে আমরা উৎসাহিত করতে পারি। দেশীয় শিল্প বিকশিত হোক।

জানা গেছে, দেশের মোট বিটুমিন চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ আমদানি করা হয়। তথ্য বলছে, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা থাকা একটি দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে তৈরি হওয়া বিটুমিনই মূলত আমদানি হয়ে বাংলাদেশে আসে। বিটুমিন আমদানিতে বেশ কয়েকটি ফাঁকফোকর আছে।

এ প্রসঙ্গে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সগীর আহমেদ বলেন, বিটুমিন আমদানিতে শুল্ক করের কোনো ফারাক নেই। কিন্তু গুণগত মানের ফারাক আছে। এখানে ৫০০ মার্কিন ডলার থেকে ২০০ ডলারের বিটুমিন আছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, সরকারি গেজেটের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই বিএসটিআই, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন ও বুয়েটের অনুমোদন ছাড়াই বিটুমিন আসছে দেশে। আর তাদের এই কাজের সহযোগী বন্দরের কাস্টমস বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার ফখরে আলম বলেন, আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণা বন্ধে ব্যাপক তৎপর হচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। আগামীতে কেউ এ ধরনের অপচেষ্টা করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে।

বন্দর নগরী চট্টগ্রামে বিটুমিনের বেশ কয়েকটি গুদাম ঘুরে দেখা গেছে, আমদানির পর জাহাজ থেকে বন্দরে আনা বিটুমিনের ড্রামগুলো যাচ্ছেতাইভাবে রাখা হয়েছে শেডে। বন্দরের এই শেড থেকে বিটুমিনগুলো আবার ২-৩ বার বিক্রির অপেক্ষায়। খুঁজতে খুঁজতে একটি ব্যক্তির মালিকানাধীন গোডাউনে বিটুমিনের ড্রামের দেখা মিলল, যেখানে খোলা আকাশের নিচে ময়লা-কাদার মধ্যেই অবৈজ্ঞানিকভাবে রাখা হয়েছে বিটুমিন।

এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, বিটুমিন একটা কেমিক্যাল। স্বাভাবিকভাবেই রক্ষণাবেক্ষণের কিছু বৈজ্ঞানিক পন্থা আছে। এটা না মানলে বিটুমিনের গুণগত মান খারাপ হয় এবং তাই হচ্ছে। 

চট্টগ্রাম গুদাম মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমদানিকারকরা দ্বিতীয় দফায় আরেক ক্রেতার কাছে বিক্রি করেন। এরপর একের পর এক হাতবদল হয় বিটুমিনের। আবার গোডাউনে থাকার কারণে মানেও খারাপ হয়। খোলা আকাশের নিচে বিটুমিন পড়ে থাকায় নষ্ট হয়। বিটুমিনের ড্রাম থেকে গলে গলে পড়েও যায়।

প্রসঙ্গত, দেশের ভৌত অবকাঠামো, বিশেষত সড়ক নির্মাণে একটি অপরিহার্য উপকরণ বিটুমিন। দেশে চাহিদার এক-দশমাংশ বিটুমিন উৎপাদন করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)-এর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। অবশিষ্ট বিটুমিন আমদানি করেই চাহিদা মিটিয়ে থাকেন ব্যক্তি উদ্যোক্তারা। বিটুমিনের বিভিন্ন গ্রেড থাকলেও ‘৬০-৭০’ গ্রেডের বিটুমিন নিয়ে যেমনটি রয়েছে রহস্য, তেমনটি সমালোচনারও কমতি নেই। বিটুমিন উৎপাদন ও বিপণনে অনৈতিক লেনদেনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগও রয়েছে। তবে কেউ এসবের দায় নিতে রাজি নয়।

সাধারণত স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগ (এলজিইডি) এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ সড়ক নির্মাণের জন্য বিটুমিন ব্যবহার করে থাকে। দেশে বছরে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টন বিটুমিনের প্রয়োজন পড়লেও ইস্টার্ন রিফাইনারি উৎপাদন করে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টন।

সর্বশেষ গত বছর ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিপিসি’র হালনাগাদ পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, করোনা মহামারীকালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪ হাজার ৬০১ টন বিটুমিন বিক্রি করেছে বিপিসি, যা আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ছিল ৬৬ হাজার ৪৪৮ টন। একই অর্থবছরে ৬৯ হাজার ৮৭৭ টন বিটুমিন উৎপাদন করেছে ইস্টার্ন রিফাইনারি।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিটুমিনের এই অব্যবস্থাপনা থেকে বের হওয়ার জন্য আমদানি হওয়া বিটুমিন যথাযথভাবে শুল্কায়নের মাধ্যমে খালাসের আগে অবশ্যই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন-বিএসটিআই, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড-ইআরএল থেকে মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সনদ বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads