• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ইয়াস তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূল

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২৭ মে ২০২১

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে খুলনা-সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নদনদীতে জোয়ারের পানি অস্বাভাবিক বেড়ে প্লাবিত হয়েছে উপকূলীয় এলাকা। কয়েক জায়গায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। শক্তিশালী এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে অতি জোয়ার বা জলোচ্ছ্বাসে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে নয় জেলার। ইয়াসের প্রভাবে সারা দেশে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে শিশু চারজন। গতকাল বুধবার সকালে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উপকূলীয় জেলাগুলোর নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায়। পানির প্রবল চাপে মুহূর্তেই প্লাবিত হয়েছে অসংখ্য বাড়িঘর, উপড়ে পড়েছে গাছপালা, তলিয়ে যায় মাছের ঘের আর মৌসুমি সবজির ফসলের ক্ষেত। লোকালয়ের পানি ঢুকে পড়ায় পানিবন্দি গ্রামবাসী। ইয়াসের প্রভাবে উপকূলের নদনদীতে ৪ ফুট পর্যন্ত পানি বেড়েছে। নদনদী উত্তাল হয়ে ওঠে। 

ক্ষতিগ্রস্ত জেলার মধ্যে রয়েছে-সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর। এ ছাড়া ভোলায় মেঘনার পানি বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তলিয়ে গেছে অন্তত ৩০টি দ্বীপচর। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, ইয়াসের প্রভাবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর,  বরগুনা,  পটুয়াখালী,  বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী,  লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম জেলাগুলো এবং তার আশপাশের দ্বীপ ও চরগুলোতে দমকা হাওয়াসহ  ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। এসব এলাকার নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুটে বেশি উচ্চতার জোয়ারের শঙ্কা আছে।

আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা জানান, ইয়াসের প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ভারি বৃষ্টি, দমকা হাওয়াসহ জলোচ্ছ্বাস হয়। প্লাবিত এলাকাগুলোতে পানি বাড়তে পারে। নতুন এলাকা প্লাবিত হতে পারে। আজ বৃহস্পতিবারও এর প্রভাব থাকবে।  আগামীকাল শুক্রবার থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপকূলে বাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। প্রবাহিত হয়েছে বহু গ্রাম। লবণপানি প্রবেশ করায় লোকালয়, ফসলি জমি ও মৎস্য ঘের হুমকির মধ্যে পড়েছে। গতকাল বেলা ১১টার পর থেকে জোয়ারের পানি বাড়তে শুরু করে। উত্তাল ঢেউ এসে আঘাত করে দুর্বল বেড়িবাঁধে। প্রথম পর্যায়ে বাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে শুরু করে।

পরবর্তীতে নদী উত্তাল হয়ে উঠলে বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। সেখান থেকে লোকালয়ে নদীর নোনা পানি প্রবেশ করে। প্লাবিত হয় বহু গ্রাম। ইয়াসের প্রভাবে উত্তাল ভোলার মেঘনা। এতে উপকূলের চরাঞ্চলের ঘরবাড়ি, রাস্তাসহ বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গেছে। ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের। উপকূলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন সাইক্লোন শেল্টারে।  ঢালচর, কুকরী-মুকরী, চরপাতিলা, চরজ্ঞান, সোনার চর, কুলাগাজীর তালুক, চর যতিন, চর শাহজালাল, কলাতলীর চরে ৩-৫ ফুট জলোচ্ছ্বাস হয়েছে।

কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা শহরে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে লোকালয়ে। ৪৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বাড়িঘর বিধ্বস্ত ও নষ্ট হয়েছে পাঁচ শতাধিক। বিশেষ করে কুতুবদিয়া ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। সাগর উত্তাল থাকায় ঢেউয়ের তোড়ে ভেঙে গেছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের একমাত্র জেটি।

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে নিঝুমদ্বীপ জাতীয় উদ্যানের মধ্যে উঁচু জায়গা না থাকায় উদ্যানে থাকা ৬ হাজার হরিণের জীবন বিপন্নের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন নদীগুলোতে জোয়ারের পানি পাঁচ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে।  প্রবল জোয়ারে শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের জেলেখালি ও নাপিতখালিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে বালির বস্তা দিয়ে তা বন্ধের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন।

উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের সকল নদীর পানি স্বাভাবিক জোয়ারের থেকে দুই থেকে আড়াই ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই মধ্যে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে মোরেলগঞ্জ উপজেলার পৌর এলাকাসহ সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম। তবে এ উপজেলার পানগুছি নদীর তীরে থাকা শানকিভাঙ্গা ও বদনীভাঙ্গা গ্রামের বেড়িবাঁধ না থাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয় মানুষের মধ্যে। যে কারনে ঝড়ের প্রভাব শুরুর আগে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এই দুই গ্রামের বাসিন্দারা। একই ভাবে জেলার শরণখোলা রামপালসহ বিভিন্ন এলাকায় জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

পানির স্রোতের তীব্রতা ও টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকার কারণে  বরগুনার বামনা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেরিবাঁধ ভেঙে নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ফলে তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও মাছের ঘের। অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা শত শত পরিবার এখন পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ৫ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান, ১৫০ হেক্টর জমির মুগডাল, ১০০ হেক্টর জমির মরিচ, ও ১৫৫ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া প্রায় ৪ হেক্টর জমির পানের বরজ, ৩০ হেক্টর জমির কলা খেত এখন পানির নিচে রয়েছে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর প্রভাবে পানিতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। পানিবন্ধি হয়ে পরেছে বলেশ্বর নদী বেষ্টনী এলাকার ৫টি ইউনিয়নের সহস্রাধিক পরিবার। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। শত শত পরিবার গৃহ পালিত পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। মঙ্গলবার রাতে স্বাভাবিক জোয়ারের তুলনায় ৮ ফুট পানি বেশি হওয়ায় মাছের ঘের ডুবে যাওয়ায় হতাশ হয়েছেন মৎস্যচাষিরা। উপজেলার বেতমোর রাজপাড়া ইউনিয়নের বলেশ্বর নদীর মাঝখানের ক্ষুদ্র দ্বীপ মাঝের চর পানিতে প্লাবিত হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে অর্ধশতাধিক রাস্তা। বৈদ্যুতিক খুটি উপড়ে পরেছে। অর্ধশতাধিক দোকানঘর বসতঘর উল্টে পরেছে। কাউখালীতে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪/৫ ফুট পানি বেড়ে যাওয়ায় ঘর বাড়ি, রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের পায়রা ও শ্রীমন্ত নদীতে স্বাভাবিকের ৫-৬ ফুট পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। রামপুর এলাকার অরক্ষিত বেড়িবাঁধ ও দেউলী সুবিদখালী ইউনিয়নের চরখালী-মেন্দিয়াবাদ এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে নিম্নাঞ্চলসহ ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মাধবখালী ইউনিয়নের আর্জি দুর্গাপুর থেকে পূর্ব রামপুর পর্যন্ত ৫শ ফুট রিং বেড়িবাঁধ ভেঙে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ১০-১৫ সহস্রাধিক মানুষ।

ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালীসহ বিভিন্ন নদনদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৪ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। পানির চাপে জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। ফলে প্লাবিত হয়েছে অন্তত ১৫টি গ্রাম। পানি বৃদ্ধির কারণে অনেকের ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় তারা রান্না করতে পারছেন না। জেলাজুড়ে এখনো থেমে থেমে বৃষ্টি পড়ছে ও দমকা হাওয়া বইছে।

কলাপাড়ার মহিপুরের নিজামপুর বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দেয়। জোয়ারে নদীর পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। ধানখালীর লোন্দা নিশানবাড়িয়া গ্রামের বাঁধের প্রায় ৩০ মিটার বাঁধ টিয়াখালী নদীর পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়ায় প্লাবিত হয় দুটি গ্রাম গ্রাম। এ ছাড়া চম্পাপুর ইউনিয়নের দেবপুর, লালুয়ার চাড়িপাড়াভাঙ্গা বাঁধের নতুন করে আরো তিনশ মিটার ভেঙে যায় রাবনাবাদ নদীর জোয়ারের পানির তোড়ে।

অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে দিনরাতে দুবার করে প্লাবিত হচ্ছে বরগুনার উপকূল। নিকটবর্তী সাগর ও নদীতে জোয়ারে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে গেছে শত শত গ্রাম, বাড়িঘর,  নিম্নাঞ্চলের আবাসন প্রকল্প, ফসলি জমি, পুকুর ও ঘের। পানিতে প্লাবিত হয়েছে বাড়িঘর। অস্বাভাবিক জোয়ারের কারণে জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগের দুটি ফেরির আমতলী-পুরাকাটা ও বাইনচটকী-বড়ইতলা পন্টুন তলিয়ে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন।

পূর্ণিমা ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে মঙ্গলবার রাতে সৃষ্ট উঁচু জোয়ারে বরগুনার লক্ষাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads