• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা পেশা বদলাচ্ছেন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৮ মে ২০২১

রাজধানীর মিরপুর শেওড়াপাড়ায় থাকেন আরিফা আক্তার (ছদ্মনাম)। তিনি ওই এলাকার একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক। স্কুলটি তিনি উদ্যোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন বছর পাঁচেক আগে। ভালোই কাটছিল তার দিনকাল। বাসাতেও তিনি ব্যাচ পড়াতেন। করোনার এ সময়ে তার স্কুলটি চালানো সম্ভব হয় না। পাশাপাশি ব্যাচ পড়ানোও বন্ধ হয়ে যায়। মড়ার উপর খাঁড়ার গায়ের মতো স্বামী পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে তাকে ডিভোর্স দেন। এখন দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি অথৈ সাগরে পড়েছেন। একমাত্র বোনের উপার্জনে কোনোমতে চলছে তার সংসার। আশায় বুক বেঁধে আছেন কখন করোনার সংক্রমণ কমবে। দেশে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। এর মাঝে ঠিকভাবে বাড়িভাড়া না দিতে পারায় তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। মিরপুরের ‘সান ওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রধান মনোয়ার মারা যান ২০২০ সালের ৩ জুন। বকেয়া বাড়িভাড়া দেড় লাখ টাকা পরিশোধ না করতে পারায় মানসিক চাপে স্ট্রোক করে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান স্ত্রী তানিয়া সুলতানা। স্বামী হারিয়ে দুই শিশু সন্তান নিয়ে স্কুলেই বসবাস শুরু করেছেন তিনি। বকেয়া পরিশোধ তো দূরের কথা এখন আর নিয়মিত বাড়িভাড়াও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না তার পক্ষে। বাড়ির মালিক তাকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কদিন আগে তার দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন তানিয়া সুলতানা।

শুধু আরিফা-তানিয়া এমন বিপদে পড়েছেন তা নয়, এরকম অনেকে রয়েছেন যারা বাড়িভাড়া শোধ করতে না পেরে পুরো বিদ্যালয়ই বন্ধ করে দিয়েছেন। কেউ কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আশায় রয়েছেন শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হতে পারে। তখন হয়তো কোনো একটা ব্যবস্থা করে বিদ্যালয় আবার শুরু করা যাবে। স্কুল চালানোর ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। বকেয়া পরিশোধ করতে না পারায় বাড়িও ছাড়তে পারছেন না। এ এক উভয় সংকট। এই পরিস্থিতিতে কিন্ডারগার্টেনের কর্মচারীদের অনেকে বদলে ফেলেছেন পেশা। বেছে নিয়েছেন ফল বিক্রি, নৌকা চালনা, অটো চালনা কিংবা বিস্কুট বিক্রির পেশা।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, করোনায় এক বছরের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলোর ৬০ শতাংশ শিক্ষক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছে। পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে সারা দেশের ৪৯টি কিন্ডারগার্টেন। বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে আরো চারটি কিন্ডারগার্টেনের।

এসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান বলছে, করোনার কারণে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে না পেরে মানসিক চাপে মারা গেছেন তিনজন স্কুলপ্রধান। এদের মধ্যে সান ওয়ার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলপ্রধান মনোয়ার স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এছাড়া কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার প্যারাগন কিন্ডারগার্টেনের রওশন কবীর এবং ব্রহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার আলোকান্দি বিদ্যাপিঠের আব্দুল খালেক আত্মহত্যা করেছেন।

এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, পুরাপুরি বন্ধ হয়ে গেছে ৪৯টি কিন্ডারগার্টেন। বন্ধের উপক্রম হয়েছে বাড্ডা এলাকার টাইনি টটস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জুরাইনের আলমবাগ কিন্ডারগার্টেন এবং গাবতলীর ইউ এন এ মডেল স্কুল এবং মডার্ন একাডেমীসহ চার প্রতিষ্ঠান। বিক্রির তালিকায় রয়েছে ৮টি কিন্ডারগার্টেন। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ভেড়িবাঁধ এলাকার ফুঁলকুড়ি কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড হাই স্কুল, সাভারের বাইপাল এলাকার সৃজন সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজধানীর কচুক্ষেত মাটিকাটা এলাকার আইডিয়াল পাবলিক স্কুল, রামপুরার উলন রোডের হলি ভিশন রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বসিলার রাজধানী আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, সাভারের পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, রাজধানীর রামপুরার ইকরা কিন্ডারগার্টেন, কচুক্ষেত মাটিকাটা এলাকার  ব্লু বার্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল।

এসোসিয়েশন বলছে, শিক্ষকতা পেশা পরিবর্তন করেছেন ২২ জন। এদের মধ্যে মেহেরপুরের রোজ ডেল কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক শাফিউর রহমান সুরুজ বিস্কুট বিক্রি করে সংসার চালান। রাজধানীর আদাবরের পপুলার কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক আমেনা বেগম ও আরবি শিক্ষক ইমরান ফল বিক্রি করে তাদের সংসার চালান। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের রওজাতুল আদব কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক মেহেরুল ইসলাম নৌকা চালক হিসেবে পেশা বেছে নিয়েছেন। এছাড়া খুলনার পাইকগাছার ডেলুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ধর্মীয় শিক্ষক রবিউল আওয়াল ফল বিক্রি করেন এবং মেহেরপুরের কিডস ওয়ার্ড স্কলার্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ শিক্ষক সুজন ইসলাম অটো চালান। এছাড়া বাসাভাড়ার খরচ কমাতে বিদ্যালয় ভবনে অবস্থান করছেন ৫ জন। বাড়িভাড়া কিছুটা পরিশোধ করেছেন ৭টি কিন্ডারগার্টেন।

পেশা পরিবর্তনকারী রোজগার্টেন হাই স্কুল সাবেক শিক্ষক ফারজানা আক্তার বলেন, ‘কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আমরা বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত। আমাদের কেউ হারাচ্ছে কর্মসংস্থান কেউ বা আবার জীবিকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করছেন। আমি ও অনেকের মধ্যে একজন ভুক্তভোগী। আমাকেও করোনা বাধ্য করেছে শখের পেশা, প্রিয় কাজের জায়গা এবং সহকর্মীদের ছেড়ে যেতে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের মহাসচিব মিজানুর রহমান সরকার বলেন, ‘দেশের ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেনে লেখাপড়া করে প্রায় ৭৫ লাখ ছাত্রছাত্রী। এতে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছে ৬ লাখ। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ড্রপ আউট হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। যেসব প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের মাত্র ১০ শতাংশ অনলাইনে অংশ নিচ্ছে।’ মিজানুর রহমান সরকার আরো বলেন, ‘ভাড়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ২০ ভাগ শিক্ষা উদ্যোক্তা। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও আত্মসম্মানের কথা ভেবে গোপন রাখছেন। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে বছর শেষে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাবে আরো প্রায় ১২ হাজার কিন্ডারগার্টেন। সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ড্রপ আউট হয়েছে ৩০-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী। অনলাইনে অংশগ্রহণ করছে মাত্র ১০ শতাংশ।’

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী ও কিন্ডারগার্টেন মালিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে তারা কোনোমতে বেঁচে আছেন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা মেলেনি। তিনি জানান, অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। যাদের নিজেদের পুঁজি ছিল, তারা তা ভেঙে কোনোরকমে স্কুল টিকিয়ে রেখেছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads