• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

একশ বছরে ৪৫ ভূমিকম্প

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০১ জুন ২০২১

প্রচলিত একটি কথা আছে প্রতি শতকে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে প্রকৃতিতে। বেড়ে যায় দুর্যোগের মাত্রা। পরিবর্তন আসে প্রাকৃতিক দুর্যোগের আচরণেও। এই কথাই কি ঠিক হতে যাচ্ছে সিলেটের ক্ষেত্রে। কারণ, সিলেটে একশ বছরে ৪৫ ভূকম্পনের দশটিই ২০২০-২১ সালের মধ্যে হয়েছে।

তথ্য বলছে, সিলেটসহ আশপাশের অঞ্চলে সবশেষ বড় ভূমিকম্প হয় ১৯১৮ সালে। সেই বছরের ৮ জুলাইয়ের ওই ভূকম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ২ ম্যাগনিচিউড। যার কেন্দ্র ছিল নেত্রকোণায়। সেই ভূমিকম্পের পর পার হয়েছে ১০৩ বছর।

জার্মানভিত্তিক ভূমিকম্প ও আগ্নেয়গিরি পর্যবেক্ষক সংস্থা ভলকানো ডিসকভারি থেকে সিলেট অঞ্চল ও সিলেটের নিকটবর্তী ভারতের আসাম, মনিপুর ও ত্রিপুরা অঞ্চলের ভূকম্পনের পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯০০ সাল থেকে ২০২১ সালের ২৯ মে পর্যন্ত এই অঞ্চলে রিখটার স্কেলে ৩ মাত্রার উপরে অন্তত ৪৫টি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে ১৯০০ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ৭৯ বছরে হয়েছে ১১টি। কিন্তু হঠাৎ এর হার বেড়ে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ১০ বছরে হয়েছে ১২টি ভূমিকম্প। পরবর্তী দশক ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত হয় ৬টি ভূমিকম্প। তবে এরপর কমে যায় ভূমিকম্পের পরিমাণ। ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ভূমিকম্পের হার কমে ২০ বছরে হয় মাত্র ৬টি। কিন্তু ভয়াবহভাবে ভূমিকম্প বেড়ে যায় ২০২০ সাল থেকে। সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০২০ সালে এই অঞ্চলে ভূমিকম্প হয় ৪টি। এর মধ্যে ১টি জানুয়ারি, একটি জুন এবং অপর দুটি হয় জুলাই মাসে। ২০২১ সালের শুরু থেকে ভূমিকম্পের এই ক্রমবর্ধমান গতি আরো বেড়ে যায়। এই বছরের ২৭ এপ্রিল প্রথমে ৩ দশমিক ০০ মাত্রার একটি ভূকম্পন হয়। তার পরদিনই হয় ৬ দশমিকি ০০ মাত্রার আরো একটি ভূমিকম্প। গত শনিবার (২৯ মে) পর পর ৭টি ভূকম্পন অনুভূত হয় বলে জানায় স্থানীয়রা। তবে এর মধ্যে ৪টির রিখটার স্কেলে ধরা পড়ার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। ভলকানো ডিসকভারও এই দিন ৪টি  ভূমিকম্প তাদের তালিকার দেখিয়েছে।

ভলকানো ডিসকভারি আরো জানায়, ১২১ বছরে ৪৫টি ভূমিকম্পের মধ্যে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার উপরে ভূমিকম্প হয়েছে ২টি। এর মধ্যে একটি ১৯১৮ সালে ৭ দশমিক ২ মাত্রার এবং অপরটি ১৯৩০ সালে ছিল ৭ দশমিক ১ মাত্রার। এছাড়া, ৬ মাত্রা ও তার উপরে ১০টি, ৫ মাত্রা বা তার উপরে ২৪টি, ৪ মাত্রার ৪টি এবং ৩ মাত্রা ও তার উপরে ছিল বাকি ৫টি ভূমিকম্প। তবে এ তথ্যে ১টি ছাড়া গত দুই বছরের সবকটি ভূমিকম্প ৩ থেকে ৪ মাত্রার মধ্যে ছিল বলে জানানো হয়।

সিলেট অঞ্চলে ভূমিকম্প নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-এর পরিবেশ ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জহির বিন আলম বলেন,  ‘একশো বছর’-এর সূত্রে ভূকম্পন বেড়েছে এটি মানুষের ধারণা মাত্র। আগে এক সময় ধারণা করা হতো প্রতি শতকে প্রাকৃতিক পরিবর্তন হয়। এর কারণে দুর্যোগেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু এখন তো অনেক দ্রুত আবহাওয়া পরিবর্তন হয়। প্রতি দশকেই দৃশ্যমান অনেক পরিবর্তন দেখছি।

তিনি বলেন, ২৯ মে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে এর সবগুলো ভূমিকম্প ছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার। ছাতকের আশপাশে ভারতের অভ্যন্তরে মেঘালয়ে চুনা পাথরের পাহাড় রয়েছে। যা ডাইনামো ফাটিয়ে পাহাড় ভেঙে সংগ্রহ করা হয়। সেদিন এমন কোনো বিস্ফোরণ তারা ঘটিয়েছে কি-না, এর কোনো প্রভাব ছিল কিনা সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আমরা এক সপ্তাহ সময় নিচ্ছি। এসব বিষয় জানারও চেষ্টা করছি। একইসংগে জনগণকে সচেতনও থাকতে বলছি। প্রশাসনকে বলেছি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দ্রুত রিপেয়ার করতে। ঝুঁকিপূর্ণ ২৬টি ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে। কয়েকটি মার্কেটও আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে মহড়াও শুরু হচ্ছে বলে তিনি জানান।

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আর্থ অবজারভেটরি। সিলেট অঞ্চলে কেন বাড়ছে ভূকম্পন, সে বিষয় নিয়ে সংস্থাটির পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেছেন, শতকের বিষয়টিকে ভিত্তিহীন বললেও ভূমিকম্প প্রবণতা যে বেড়েছে তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই তাঁর। এই ভূমিকম্প গবেষকের মতে, সিলেট অঞ্চলে প্লেটের নিচে প্রচুর শক্তি মজুত হয়েছে। যার প্রভাবেই বাড়ছে ভূকম্পনের হার। 

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, সিলেট অঞ্চলটা প্লেটের সংযোগ স্থলে অবস্থিত। এখানে দুটি উৎস আমরা নির্ণয় করেছি। এর মধ্যে একটি ডাউকি ফল্ট, অপরটি বার্মার প্লেটটি। এখানে প্রচুর পরিমাণ এনার্জি জমেছে। যে পরিমাণ শক্তি আছে তা ৮ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প ঘটাতে পারে যে কোনো সময়। সেখানকার জমানো এনার্জি একবারে বড় ভূকম্পনেও বের হতে পারে, আবার বার বার ছোট ছোট ভূমিকম্পের মাধ্যমেও বের হতে পারে। 

এই ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, তবে সেখানে যে টেকটনিক সেট-আপ আছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বলছে সেটি একবারেই ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ এনার্জি বের করে দেওয়ার কথা। তারপর আফটার শকের মাধ্যমে ৬ মাস-১ বছর ধরে বাকিটা বের হওয়ার কথা। আস্তে আস্তে সেটা যখন বেড়ে আটকে থাকা এনার্জির মাত্রা অতিক্রম করবে তখনি বড় ধাক্কায় বেরিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads