• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

লকডাউন কার্যকর নিয়ে প্রশ্ন

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৮ জুন ২০২১

করোনাভাইরাসের সংক্রামণ রোধে গত ১৫ মাসে দেশে কয়েক দফা লকডাউন ও কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার। কিন্তু লকডাউনকে যে নামেই বিশেষায়িত করা হোক না কেন, তা থেকে কার্যকর কিছুই মিলছে না। দেশ এখন করোনার সর্বোচ্চ আঘাতে বিপর্যস্ত। লকডাউন কার্যকর না হওয়ায় এখন এমন কোনো জেলা নেই যেখানে করোনার ঝুঁকি নেই। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন কিছু শর্ত সংযুক্ত করে আজ থেকে তিনদিনের জন্য সীমিত আকারের লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। এরপরে আসছে ’সর্বাত্মক লকডাউন’। তাই অতীতের অভিজ্ঞতায় প্রশ্ন উঠেছে সীমিত লকডাউন ও সর্বাত্মক লকডাউন কেমন হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে অতীতে লকডাউন এবং কড়াকড়ি নিয়ে বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেক্ষেত্রে নতুন নাম ‘কঠোর লকডাউন’ বা ‘শাটডাউন’ দেওয়া হোক না কেন, এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। অতীতে যে কারণগুলোর জন্য লকডাউন সফলতা পায়নি, সে কারণগুলোর সুরাহা করতে হবে। নইলে ঘোষিত লকডাউনকে সফল করা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। আজ থেকে ১৫ মাস আগে, করোনা যখন দেশে প্রথম আঘাত হানে, তখন আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও এতখানি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়িনি। তবে রকমফের আছে-মধ্যম ঝুঁকি, উচ্চ ঝুঁকি এবং অতি উচ্চমাত্রার ঝুঁকির। করোনা মোকাবিলা করতে গিয়ে অপরিকল্পিত লকডাউন দিয়ে একদিকে যেমন লকডাউন কার্যকর হচ্ছে না, অন্যদিকে জনগণের ‘লাইফডাউন’ হয়ে গেছে। কার্যকর ‘লকডাউন’ বলতে যা বোঝায়, তা এখনো অনেক দূরে। করোনার এত ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব একটা জনসচেতনতা গড়ে উঠেনি। স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানার ক্ষেত্রেও রয়েছে উদাসীনতা। জীবিকার তাড়নায় ঘরের বাইরে গেলে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, আর বিনা খাদ্যে বাড়িতে থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু হবে। তাই নিম্নআয়ের মানুষ জীবিকার তাগিদে অনেকটাই বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামছে। ফলে ঢাকার চারপাশের সাত জেলায় লকডাউন দিয়ে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময় কঠোরও হতে পারছে না। তাছাড়া লকডাউন কার্যকর করতে অতীতে সঠিক কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ফলে সফল হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরে খাবার না থাকলে, আয় না থাকলে মানুষ ঘরে আটকে রাখা যাবে না। সুতরাং লকডাউন কার্যকর করার প্রথম শর্তই হলো রাষ্ট্র সংশ্লিষ্টদের সাধারণ মানুষের জন্য ন্যূনতম খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করা। যদিও এটা কঠিন কাজ কিন্তু অসম্ভব নয়। অন্যদিকে এখন আর অঞ্চলভিত্তিক বিধিনিষেধ আরোপ করে কোনো ভালো ফল পাওয়া যাবে না। তাই গোটাদেশে কমপক্ষে ১৪ দিনের জন্য কারফিউয়ের মতো করে ‘কঠোর লকডাউন’ জারি করা জরুরি। নইলে ঢিলেঢালা কর্মসূচির দ্বারা করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশে আজ থেকে নতুন বিধিনিষেধ এবং বৃহস্পতিবার থেকে দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন শুরু হচ্ছে। করোনাসংক্রান্ত জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির ১৪ দিনের শাটডাউনের প্রস্তাবে এই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সাত দিনের জন্য সিদ্ধান্ত হলেও তা আরো বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মো, শহীদুল্লাহ বলেন, সংক্রমণ ঠেকাতে হলে লকডাউন হতে হবে কারফিউর মতো।

গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়।  ১৮ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি দিয়ে করোনা সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়। আর এবার করোনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে কঠোর বিধিনিষেধ এবং আঞ্চলিক লকডাউন চলছে।

অতীতে লকডাউন এবং কড়াকড়ি নিয়ে বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। পোশাক কর্মীদের ছুটি দিয়ে আবার করোনার মধ্যেই ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। গণপরিবহন বন্ধ রেখে ব্যক্তিগত যানবাহন চলেছে। এখনো সারা দেশে কড়াকড়ি রয়েছে, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছুই খোলা রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানার ক্ষেত্রেও রয়েছে উদাসীনতা। ঢাকার চারপাশের সাত জেলায় লকডাউন দিয়ে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ যে কোনো উপায়ে ঢাকার বাইরে যাচ্ছেন। আবার ঢাকায়ও মানুষ আসছেন। দূরপাল্লার যানবাহন বন্ধ থাকলেও এই যাত্রা থামানো যাচ্ছে না। সোমবার থেকে কঠোর লকডাউনের ঘোষণার পরও অনেকে ঢাকা ছাড়ছেন। একইভাবে ঢাকায়ও আসছেন সমানভাবে।

সর্বাত্মক লকডাউন কার্যকর করতে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী এবং বিজিবি মোতায়েন থাকবে বলে জানানো হয়েছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার নির্দেশনাও থাকছে। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হওয়ার জন্য পুলিশের কাছ থেকে এবারো মুভমেন্ট পাস নিতে হবে। জরুরি সেবা ছাড়া দোকানপাট, সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত, শিল্পকারখানা, যানবাহন চলাচল সব কিছু বন্ধ থাকবে। আর্থিকসহ অন্যান্য সেবা দেওয়ার প্রয়োজনে কিছু অফিস সীমিত আকারে খোলা থাকবে  সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা লকডাউনের আওতায় পড়বেন না। তবে পোশাক কারখানা খোলা রাখার দাবি জানিয়েছেন পোশাক কারখানার মালিকরা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, শাটডাউন, লকডাউন, কঠোর বিধিনিষেধ একেক সময় একেক শব্দ ব্যবহারের কারণে নানা দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। একটা কঠোর বিধিনিষেধ চলমান আছে। তাহলে সোমবার থেকে বুধবার আবার সীমিত বলায় জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে।

তিনি বলেন, লকডাউন কার্যকর করতে হলে সাম্যতার প্রয়োজন হয়। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে কিন্তু ব্যক্তিগত যানবাহন চলবে এটা হয় না। পোশাক কারখানা খোলা থাকবে কিন্তু দোকানপাট বন্ধ থাকবে সেটাও হয় না। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সব বন্ধ রাখতে হবে। করোনা ছাড়ানো বন্ধ করতে হলে সঠিকভাবে লকডাউন কার্যকর করতে হবে। এরজন্য অতীতে সঠিক কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ফলে সফল হয়নি। এবার যে কঠোর লকডাউনের কথা বলা হচ্ছে তার জন্য পরিকল্পনা কী তা এখনো স্পষ্ট নয়।

একই ধরনের কথা বলেন বিএসএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, লকডাউনের আগে একটি প্রস্তুতি থাকতে হয়। লকডাউনের সময় পুরো দেশ কীভাবে চলবে। জরুরি সেবাসহ খাদ্য ও পণ্য সরবরাহ কীভাবে হবে তার গাইডলাইন থাকতে হয়। লকডাউন মানতে আইনের প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু এখানো সেই পরিকল্পনা স্পষ্ট নয়।

তিনি বলেন, ‘লকডাউনে গরিব মানুষ কী খাবে। তাদের ঘরে রাখা যায় কীভাবে তার সুনির্দিষ্ট পরিকলল্পনা দিতে হয়। তাদের যদি খাবার না থাকে, আয় না থাকে তাহলে তাদের ঘরে আটকে রাখা যাবে না। তাই তাদের যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর মানুষ যাতে ঘরে বসে খাদ্য ও জরুরি সেবা পেতে পারে তার সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে না পারলে লকডাউন কার্যকর করা অসম্ভব।

জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশে এখন করোনার সংক্রমণ খুবই উচ্চহারের। তাই সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর লকডাউন কার্যকর করার কোনো বিকল্প নাই। সেই সঙ্গে পরামর্শক কমিটি আরো মনে করে, দেশের অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অর্থনীতির চাকা তো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা যাবে না, তাই বেশিরভাগ মানুষকে টিকার আওতায় এনে একটি ন্যূনতম কর্মপরিবেশ তৈরি করা যাবে। কমিটি তাদের শাটডাউনকে ‘ক্লোজ টু কারফিউ’ বোঝাতে চাইছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads