• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

দেশে বাড়ছে দারিদ্র্য, কমছে বেসরকারি সহায়তা

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৬ জুলাই ২০২১

করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ রোধে দফায় দফায় লকডাউনের আদলে বিধিনিষেধের ফলে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা। অভিযোগ উঠেছে, দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করতে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হতে নিলেও তা পর্যাপ্ত না। আবার গত বছর করোনার সংক্রমণ শুরুতে লকডাউনে দরিদ্র মানুষকে সহায়তা করতে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে উদ্যোগ ছিল তাও কমে আসছে।

গত বছরের মার্চ মাস থেকে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ায় দেওয়া হয় কঠোর বিধিনিষেধ। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েন অনেক মানুষ। তাদের সহায়তার জন্য সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল এবং ব্যক্তি পর্যায় থেকেও দেওয়া হয় বিপুল পরিমাণ সাহায্য। সহায়তা করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন অনেকে। কিন্তু এই সঙ্কট যতই দীর্ঘায়িত হতে থাকে ততই সঙ্কুচিত হতে থাকে এই সহায়তা। 

তবে বেসরকারি সহায়তা পর্যায়ে সহায়তা কমার জন্য মানুষের আর্থিক সঙ্কটের পাশাপাশি করোনা সংক্রমণের ভীতিকেও দায়ী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কোভিড-১৯ মহামারিতে সহায়তা প্রদান করা প্রথম প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। অসহায় জনগোষ্ঠীকে খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে এগিয়ে আসা সংগঠনটি এখন পর্যন্ত ২ লাখ পরিবারকে খাবার প্রদান করেছে বলে জানা যায়। এখন পর্যন্ত সংগঠনটি মোট ৫ হাজার পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই) এবং ২০ হাজার ফেস মাস্ক বিতরণ করেছে। চট্টগ্রামে ৯ হাজার পরিশোধক বিতরণ করছে বিদ্যানন্দ। সম্প্রতি কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মোট ২২ হাজার পরিবারকে সাহায্য প্রদানের জন্য বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা আর্থিক সহযোগিতা করেছে সুহানা এন্ড আনিস আহমেদ ফাউন্ডেশন (এসএএএফ)। বিদ্যানন্দের মাধ্যমে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী, বিজিবি এবং স্থানীয় সংস্থাগুলোর সহায়তায় এই সংকটকালীন সময়ে প্রতি পরিবারের কাছে মোট ৩ বেলার এই সহযোগিতা পৌঁছে দেবে এসএএএফ। সহযোগিতার এই অর্থের শতকরা ৯০ শতাংশ বিতরণ করা হবে ঢাকার বাইরে, যেখানে থাকবে চাল, ডাল, তেল, আটা, লবণ, সুজি ইত্যাদি।

সরকারের পক্ষ থেকেও অব্যাহত আছে সহায়তা। ৩৩৩ নম্বরে ফোন করলে খাবার পৌছে দেওয়া হচ্ছে মানুষের দোড়গড়ায়। সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, কর্মহীন হয়ে পড়া দরিদ্র মানুষকে মানবিক সহায়তা দিতে সরকার এ পর্যন্ত ৫৭৪ কোটি ৯ লাখ ২৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এতে প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ পরিবার উপকৃত হবে। তিনি আরো বলেন, আমরা ৩৩৩ নম্বরটি প্রচার করেছি। কেউ খাদ্যকষ্টে থাকলে ফোন করলে তাকে তালিকাভুক্ত করে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে। কাউন্সিলরদের বলেছি যে যেখানে থাকুন না কেন খাদ্যকষ্টে থাকলে তাকে এনআইডির ভিত্তিতে খাদ্য সহায়তা দিতে হবে। তিনি জানান, সাধারণ ত্রাণ হিসেবে নগদ ১২১ কোটি টাকা, ভিজিএফের জন্য ৪৭২ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বড় সিটি করপোরেশনগুলোকে ৫৭ লাখ টাকা করে এবং ছোট সিটি করপোরেশনগুলোকে ৩২ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়েছে। পৌরসভায় ও ইউনিয়ন পরিষদগুলোতেও টাকা দেওয়া হয়েছে।

গত রোববার ডিএমপির গণমাধ্যম শাখা থেকে জানানো হয়, ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামের নির্দেশে প্রতিদিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে খাবার বিতরণ করা হবে। গত সোমবার থেকে ডিএমপির ৫০টি থানায় ৫ হাজার মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করা হবে। যা আগামী এক সপ্তাহ অব্যাহত থাকবে।

সম্প্রতি পুুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক)’র নেতৃবৃন্দ গভীর রাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অসহায় ও দুঃস্থ মানুষের মাঝে খাবার বিতরণ করেন।

এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে হাতেগোনা বৃহৎ কিছু সংগঠন অসহায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়ালেও কোনো রাজনৈতিক দল বা তাদের সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনকে এখনো কোনো ধরনের সহায়তা নিয়ে দরিদ্রদের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা যাযনি। যদিও গত বছর তাদের কিছু উদ্যোগ ছিল। আবার দেশে বিভিন্ন পাড়া মহল্লা অসংখ্য ক্লাব বা সংগঠন থাকলেও তাদেরকেও দেখা যাচ্ছে না এ ধরনের কার্যক্রমে। ব্যক্তিগত পর্যয়ে অনেকেই গত বছর সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেও এবার তাদেরকেও দেখা যাচ্ছে না।

এদিকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনার কারণে দেশে ক্রমেই বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা।

গত বছর বেসরকারি এনজিও ব্র্যাকের একটি জরিপে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে মানুষকে ঘরে থাকতে হয়েছিল। এর প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ। ফলে দেশের চরম দারিদ্র্যের হার ৬০ শতাংশ বেড়ে যায় এবং ১৪ শতাংশ (সোয়া দুই কোটি) মানুষের ঘরে কোনো খাবার ছিল না। বিশ্ব শ্রম সংস্থা (আইএলও) উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৫ মিলিয়ন মানুষ চাকরি হারাতে পারে। যার মধ্যে বাংলাদেশও আছে।

বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর কারণে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, বাংলাদেশে করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস সংকটে বিশ্বে প্রতি ছয়জনের একজন বেকার হয়েছে। আর বাংলাদেশের প্রতি চারজন যুবকের মধ্যে একজন কর্মহীন বা বেকার রয়েছেন (২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ)।

স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) এক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোভিড-১৯ এর কারণে লকডাউন ঘোষণায় বাংলাদেশে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। কর্মসংস্থান হারিয়ে ২০ শতাংশের অধিক লোক নতুন করে দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছেন।

বিশ্ব ব্যাংকের আরেকটি হিসাব অনুযায়ী, কোভিড-১৯ এর কারণে এক কোটি ৬৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে যুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ চরম দারিদ্র্যে পতিত হয়েছেন।

অ্যাসোসিয়েশন অব হোটেল ওয়ার্কার্স জানায়, চাকরি হারানোর ফলে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়েছিল বিভিন্ন হোটেল রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা। দ্বিতীয় দফা লকডাউনের কারণে হোটেল খাতের প্রায় ৩০ লাখ কর্মী কর্মসংস্থান হারিয়েছে বলে ধারণা করছেন তারা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপ অনুযায়ী, করোনার আঘাতে দেশে নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ। নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে এই নতুন দরিদ্র শ্রেণির সংখ্যা জনসংখ্যার ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত যা ছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads