• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

কালোটাকা সাদা করার রেকর্ড

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২১

সদ্য বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০ হাজার ৬০০ কোটি অপ্রদর্শিত বা কালোটাকা সাদা হয়েছে। প্রায় ১২ হাজার করদাতা এই টাকা সাদা করেন। অর্থবছরের শেষ মাস জুনেই ১ হাজার ৪৫৫ জন ৬১৯ কোটি টাকা সাদা করেছেন। এর ফলে সব মিলিয়ে সরকার কর পেয়েছে ১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। কালোটাকা সাদা করার তালিকায় আছেন চিকিৎসক, সরকারি চাকরিজীবী, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক, ব্যাংকের উদ্যোক্তা মালিক, স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ আরো অনেকে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাময়িক হিসাবে এ তথ্য জানা গেছে। শিগগিরই চূড়ান্ত হিসাব পাওয়া যাবে। শাটডাউনের পর এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সংবাদ সম্মেলন করে কালোটাকা সাদা হওয়ার সাফল্যের এ তথ্য জানাবেন । সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের পর বিদায়ী অর্থবছরেই সবচেয়ে বেশি মানুষ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিলেন। যে ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা হয়েছে, এর মধ্যে নগদ টাকা সাদা হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি। ব্যাংক বা নগদে রাখা এই বিপুল পরিমাণ টাকা সাদা করেছেন সাত হাজার করদাতা। বাকিটা টাকা জমি-ফ্ল্যাট, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়েছে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর বর্তমান সরকারের তিন মেয়াদে একাধিকবার কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও তা তেমন একটা কাজে লাগেনি। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ৩২ হাজার ৫৫৮ জন করদাতা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছিলেন। তখন অবশ্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি কালোটাকা সাদা হয়েছিল। বিদায়ী অর্থবছরের মতো এত ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ খুব একটা দেওয়া হয়নি। মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে শেয়ারবাজার, নগদ টাকা, ব্যাংকে রাখা টাকা, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া এলাকা ও আয়তনভেদে নির্ধারিত কর দিয়ে জমি-ফ্ল্যাটেও টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। কালোটাকার সবই যে অবৈধ প্রক্রিয়ায় আয় করা, তেমনটা নয়। মানুষের যে টাকার হিসাব আয়কর নথিতে উল্লেখ করা না হয়, সেটিই কালোটাকা। এ ছাড়া অবৈধ উপায় বা দুর্নীতির মাধ্যমেও বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করা হয়। সরকার চাইছে ছাড় দিয়ে হলেও সেই টাকা হিসাবের মধ্যে নিয়ে আসতে। নইলে এই টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, জুন মাস শেষে প্রাথমিক হিসাবে করদাতা ১১ হাজার ৮৫৯ জন কালোটাকা সাদা করেছেন। তাদের প্রায় ৬০ শতাংশই নগদ টাকা সাদা করেছেন। সাড়ে চার হাজারের বেশি করদাতা জমি ও ফ্ল্যাট কিনে টাকা সাদা করেছেন। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন বাকিরা।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, গত ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৬৫০ জন কালোটাকা সাদা করেছেন। ১০ হাজার ২২০ কোটি টাকা সাদা হয়েছে। তারা সবাই এনবিআরে জমা দেয়া বার্ষিক রিটার্নে এই ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে পরের ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৪ হাজার ২০৯ জন এই সুযোগ নিয়েছেন। তখন সাদা হয়েছে ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো।

এ তথ্যে থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, অর্থবছরের শেষের দিকে তুলনামূলক ধনীরা বেশি কালোটাকা সাদা করেছেন। কালোটাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক বলেন, এনবিআরের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সব শ্রেণি-পেশার মানুষই কালোটাকা সাদা করেছেন। নতুন বাজেটে এ সুযোগ দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। সে কারণে শেষের মাস জুনে যাদের বেশি কালোটাকা ছিল তারা সাদা করেছে। শেষ পর্যন্ত নতুন বাজেটেও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। আমি বরাবরই এ সুবিধা দেওয়ার বিরুদ্ধে। এতে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হয়। তাদের প্রতি অবিচার করা হয়। এ সুযোগ নৈতিকভাবে ঠিক নয়। করোনার কারণে দেশ থেকে টাকা বিদেশে নেওয়ার সুযোগ সীমিত হয়েছে। তাই হয়তো এবার বেশি সুযোগ নিয়েছেন, বলেন এই অর্থনীতিবিদ। প্রায় সরকারের আমলেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো এ দেশের করদাতাদের সামনে এই ধরনের সুযোগ আসে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫ বারের বেশি এ ধরনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তেমন একটা সাড়া মেলেনি।

২০০৭-২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ভয়ভীতির কারণে বেশি করদাতা সুযোগ নিয়েছেন। এবার ঢালাও এবং কম কর হারে সুযোগ দেওয়ায় কালোটাকার মালিকেরা উৎসাহিত হন। এ ছাড়া করোনার কারণে সব যোগাযোগ বন্ধ হওয়ায় বিদেশে টাকা পাচারের সুযোগ সীমিত হয়েছে। সে কারণেও অনেকে অবৈধভাবে উপার্জিত টাকা সাদা করেছেন।

এদিকে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটেও কালোটাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ দিয়েছে সরকার। এবার বিনা প্রশ্নে ব্যাংকে নগদ জমা, নতুন শিল্পে বিনিয়োগ, পুঁজিবাজার, ফ্ল্যাট ও প্লট, ব্যাংক আমানতসহ বেশ কয়েকটি খাতে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ো হয়েছে। তবে কর দিতে হবে বেশি। তবে এখন কালোটাকা সাদা করতে হলে কর দিতে হবে ২৫ শতাংশ। সেইসঙ্গে করের ওপর জরিমানা গুনতে হবে ৫ শতাংশ। ৩ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে বাজেট প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন, তাতে কালোটাকা হিসেবে অধিক পরিচিত ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ সাদা করার সুযোগের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

প্রস্তাবিত অর্থবিলেও তখন এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকলে কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ শেষ হচ্ছে বলে আলোচনা তৈরি হয়।

তবে বাজেট প্রস্তাবের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ বিষয়ে আলোচনার সুযোগ রেখে তা বহাল রাখার ইঙ্গিত দেন।

শেষ পর্যন্ত প্রচলিত নিয়মের বাইরেও বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে করের হার বাড়িয়ে এবং তার সঙ্গে আরও ৫ শতাংশ জরিমানা যোগ করে কোনো প্রশ্ন ছাড়া কালোটাকা সাদা করার ‘বিশেষ সুযোগ’ দিয়ে অর্থ বিল ২০২১ সংসদে পাস হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads