• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

শিল্প ও সেবা খাতে করোনার আঘাত

অনিশ্চয়তা বাড়ছে কর্মক্ষেত্রে

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১১ জুলাই ২০২১

মহামারি করোনাভাইরাস খাদের কিনারে ঠেলে দিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতিকে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশেও হুহু করে বাড়ছে দারিদ্র্য ও বেকারের সংখ্যা। দেশের বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা করোনার আঘাতে যেভাবে সংকুচিত হয়েছে, তা কবে নাগাদ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে, তাও কেউ জানে না।

এদিকে করোনার নেতিবাচক প্রভাব কাটাতে না পেরে অনেক ব্যবসা ও শিল্পকারখানা কর্মী ছাঁটাই করেছে। লাগাতার লকডাউনের কারণে এরই মধ্যে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ী তাদের পেশা পরিবর্তন করেছে। তবুও জীবন-জীবিকা নিয়ে বিপাকে মানুষ। করেনাকালেও বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। নিকট ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে আয়-ব্যয়ের সমন্বয় করা যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। আর যারা পড়াশোনা শেষ করে নতুন চাকরির বাজারে প্রবেশের অপেক্ষায় আছেন কিংবা যারা চাকরি পরিবর্তনের কথা ভাবছেন তাদের কর্মজীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা।   

করোনাভাইরাসের কারণে শুধু বাংলাদেশই নয়, পুরো বিশ্বই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন আজ। রপ্তানিতে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়েছে। এমনিতেই আমাদের দেশে ভালো চাকরি পাওয়া সোনার হরিণ হাতে পাওয়ার থেকে কম কিছু নয়। তার মধ্যে এ মহামারি দেশের শিল্প ও সেবা খাতের সরবরাহ এবং উৎপাদন পরিস্থিতিকে এমন আঘাত করেছে যে, এর ফলে অনেক যোগ্য কর্মীও কর্মচ্যুত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গত দশকের তুলনায় এবার দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে আগামীর চাকরির বাজারের অনেক চিত্র।

অন্যদিকে দারিদ্র্যবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম বলছে, করোনাকালে পৃথিবীতে খাদ্যাভাব আরো তীব্র হয়েছে। ক্রমেই বিশ্বজুড়ে তৈরি হচ্ছে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনায় মৃত্যুর গতিকে বিশ্বজুড়ে হারিয়ে দিতে শুরু করেছে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা। বর্তমানে বিশ্বে ১৫ কোটিরও বেশি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বা আরো খারাপ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে গত বছরের তুলনায় এ বছর খাদ্যের অভাব অন্তত ৬ গুণ বেড়েছে। অবস্থাটা এমনই যে, বিশ্বে এখন প্রতি মিনিটে ১১ জন অনাহারে মারা যাচ্ছে। গত শুক্রবার প্রকাশিত ‘দ্য হাঙ্গার ভাইরাস মাল্টিপ্লাইস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে অক্সফাম এসব তথ্য জানিয়েছে।

এদিকে করোনার কারণে দেশে কি পরিমান মানুষ কর্মহীন হয়েছে সরকারি ভাবে তার সুনির্দিষ্ট কোন হিসাব নেই। তবে করোনায় কর্মহীন জনগোষ্ঠী নিয়ে বেসরকারি ভাবে অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, গত এক বছরে সারা দেশে (প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের) ১ কোটি ৪৪ লাখ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। 

এরই মধ্যে শুরু হয়েছে আবার গত এপ্রিল মাস থেকে টানা দ্বিতীয় দফার ‘কঠোর লকডাউন’। ফলে অনেকে নতুন করে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন। এতে বেকারের তালিকা আরো দীর্ঘ হবে বলে আশঙ্কা করেন তিনি।

ড. আবুল বারকাতের গবেষণায় দেখানো হয়, দেশে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ৬ কোটি ৮২ লাখ ৮ হাজার মানুষ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। শুধু লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়েছেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭১ জন। অর্থাৎ মোট কর্মগোষ্ঠীর ৫৯ শতাংশ মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকার হয়েছে সেবা খাতে।

এ প্রসঙ্গে ড. আবুল বারকাত বলেন, কাজ হারানো মানুষের মধ্যে ৪০ শতাংশ সামনে কোনো কাজ ফিরে পাবে না। তাদের জন্য তিনি সরকারের কাছে বেকারদের ভাতা চালুর সুপারিশ করেছেন। এক্ষেত্রে সাময়িক ভাতা দেওয়ার চেয়ে শ্রেয় হবে তাদের কাজ দেওয়া। এ ব্যাপারে সরকারকে ভাবতে হবে। কারণ করোনার প্রভাবে আগামীতে কর্মসংস্থানের প্যাটার্নও পালটে যাবে। যেখানে গুরুত্ব বাড়বে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানের। সেদিকে সরকারকে নজর রাখতে হবে।

এদিকে বেসরকারি ও করপোরেট খাতের প্রায় ৪০ হাজার প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের প্ল্যাটফরম বিডিজবস ডট কমের সাম্প্রতিক হিসাবে জানা গেছে, গত বছর প্রথম দফায় লকডাউনের ফলে চাকরির বাজারে বড় ধরনের ধস নেমেছিল। গত ডিসেম্বর থেকে এ পরিস্থিতি উন্নতি হতে থাকলে ফেব্রুয়ারিতে দেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে জনবল নিয়োগ প্রি-প্যান্ডেমিক লবেলে উন্নীত হয়। হেভি ইন্ডাস্ট্রি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও কনস্ট্রাকশন, হসপিটাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, এগ্রো বেইজড ইন্ডাস্ট্রি, রিয়েল এস্টেট এবং ট্রেডিং সেক্টরে গত ফেব্রুয়ারিতে চাকরির বিজ্ঞাপন আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়। ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ফার্মাসিউটিক্যালস, এডুকেশন ও ইনফরমেশন টেকনোলজি খাতে গত ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রি-প্যান্ডেমিক পর্যায়ে পৌঁছে ছিল। তবে গার্মেন্ট ও টেক্সটাইল সেক্টর, সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো আগের তুলনায় কম নিয়োগ দিচ্ছিল। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফার কঠোর লকডাউনের কারণে এসব খাতে নিয়োগে ধস নেমেছে। 

করোনার প্রভাবে কর্মসংস্থানে কতোটা প্রভাব পড়ছে, কিংবা এখন পরিস্থিতি কেমন- সে সম্পর্কে কোন তথ্য নেই শ্রম মন্ত্রণালয়ে। তবে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জরিপ তথ্য অনুযায়ী, দেশে কোভিড সংক্রমণের সময় বা গতবছর মার্চে ১৭ শতাংশ ব্যবসায়ীর দোকান খোলা ছিল। জুলাই মাসে এটি কমে ১০ শতাংশে নামার পর সেপ্টেম্বরে প্রি-কোভিড পর্যায়ে উন্নীত হয়। অর্থাৎ, লকডাউনের সময় যেসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ রেখে পেশা পরিবর্তন করেছিলেন, তারা সেপ্টেম্বর থেকেই আবার ব্যবসায় ফিরেন। এভাবে গত মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রম্বান্বেয়ে আগের অবস্থায় ফিরেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দফার লকডাউনের কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠনগুলো আবার বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে উপার্জন করছেন।

বর্তমান শ্রমবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সানেম, যা আগামী ১০ মার্চ প্রকাশ করে সংস্থাটি। এই গবেষণা দলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, এখনো আমাদের অর্থনীতি শতভাগ সামর্থ্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রায় সব খাত বন্ধ রয়েছে। কিছু খাত ধীরে ধীরে সচল হচ্ছিল। এরমধ্যে দ্বিতীয় দফার লকডাউন দেশের কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে বিদ্যমান কিছু শিল্প কারখানা ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলো কোন রকমে টিকে থাকার চেষ্টার অংশ হিসেবে চালু রাখা হচ্ছে। এখন এসব ব্যবসায় তেমন লাভ না হলেও কিছু মানুষের কর্মসংস্থান এখনো রয়েছে। তবে এ লকডান যত দীর্ঘ হবে ততোই দেশের ব্যবসা ও রপ্তানি খাতগুলো ক্ষতির মুখে পরবে। যদিও পিপিই, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মতো নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সামগ্রী উৎপাদন ও বিপণনে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ইদানীং ক্যাটারিং ব্যবসাও সম্প্রসারিত হচ্ছে। সরকারের প্রণোদনা পেলে এসবখাতে বিপুল কর্মসংস্থান হতে পারে। তাছাড়া ফার্মাসিউটিক্যাল, চামড়া শিল্প ও আইসিটি খাতে এমনিতেই বিপুল পরিমাণে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এসব খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads