• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯
কঠিন চ্যালেঞ্জে স্বাস্থ্য খাত

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

কঠিন চ্যালেঞ্জে স্বাস্থ্য খাত

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৪ জুলাই ২০২১

একদিকে ঈদের আনন্দ, অন্যদিকে জীবিকা-এমনই কঠিন সমীকরণের ফাঁদে এখন বাংলাদেশ। কারণ দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুহার দুটোই ঊর্ধ্বমুখী। চলতি সপ্তাহে দৈনিক মৃত্যুহারের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশ দশম অবস্থানে চলে গেছে। শনাক্তের দিক থেকেও একের পর এক রেকর্ড ভেঙেছে এ মাসে। শনাক্ত ও মৃত্যুর যখন এমন পরিসংখ্যান, তখন ঈদকে ঘিরে লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্তে দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যু বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। এর ভেতরে লকডাউন তুলে দেওয়ায় গোটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন কম্প্রোমাইজের জন্য অনেক বেশি মূল্য দিতে হতে পারে। জীবন ও জীবিকার সমন্বয় করতে গিয়ে ভুল পথে হাঁটছে সরকার। ঈদকে কেন্দ্র করে করোনা পরিস্থিতি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যেতে পারে। দেশের সংক্রমণ আগের সব রেকর্ড ছাড়াতে পারে। এর কারণ সম্পর্কে তারা বলেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসটি একজন থেকে আরেকজনে (কমিউনিটি ট্রান্সমিশন) খুব দ্রুত ছড়ায়। এখন লকডাউন শিথিল করায় মানুষ অবাধ চলাফেরা করবে। তারা যখন একসঙ্গে বের হবে তখন ভাইরাস তার কাজ করে যাবে। তাছাড়া গণপরিবহন, শপিংমল, কোরবানির পশুর হাট, কোরবানির সামাজিকতা-এগুলো সংক্রমণ বাড়িয়ে দেবে। ঈদের এক সপ্তাহ পর থেকেই এর করুণ পরিণতি দেখা যাবে। মৃত্যু অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এমনিতে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থ্য অপ্রতুল। এর মধ্যে করোনা সংক্রামণ আরো বৃদ্ধি পেলে চিকিৎসা সংকটে প্রচুর মানুষ মারা যেতে পারে। আর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে চলমান বিধিনিষেধ গতকাল মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত শিথিল করেছে সরকার। পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপন, জনসাধারণের যাতায়াত, ঈদের আগে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। যদিও করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে সরকার এ বছরের ৫ এপ্রিল থেকে ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ দিয়ে আসছে; পাশাপাশি এবার স্থানীয় প্রশাসনও বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ বিধিনিষেধ জারি করেছিল। কিন্তু তারপরও করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় ১ জুলাই থেকে সারা দেশে চলমান বিধিনিষেধের মেয়াদ শেষ হয় গতকাল বুধবার।

এদিকে করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি দাবি করছে, তাদের পরামর্শ ছাড়াই বিধিনিষেধ শিথিল করেছে সরকার। এই সিদ্ধান্ত তাদের পরামর্শের উল্টো। এর ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন এ কমিটির সদস্যরা।

এদিকে দেশে করোনা সংক্রমণের এ পরিস্থিতিতে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও। সংস্থাটির দায়িত্বশীলরা বলছেন, শনাক্ত ও মৃতের সংখ্যা যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, তা নিয়ন্ত্রণে না আসলে ঈদ পরবর্তী সময়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি হাসপাতালে আইসিইউ শয্যাসহ কোনো সাধারণ শয্যাও খালি পাওয়া যাবে না

অন্যদিকে সরকারের জারি করা ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধের শেষ দিনে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীর সড়কে অতিরিক্ত রিকশা, মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাসের বেশ চাপ দেখা যায়। যানবাহনের চাপে কোথাও কোথাও জট দেখা গেছে। অলিগলিতে খুলেছে দোকানপাট। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ বাইরে বেরিয়ে পড়ে। এদের বেশিরভাগ স্বাস্থ্যবিধি উপক্ষা করে চলাফেরা করেছে। এমনকি অনেকেই মাস্কও ব্যবহার করেনি।

দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হুহু করে বাড়ছে। প্রতিদিনই হচ্ছে আক্রান্ত ও মৃতের নতুন নতুন রেকর্ড। চলতি মাসের প্রথম ১৪ দিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন দুই হাজার ৫৪৯ জন। যা দেশের মোট মৃত্যুর প্রায় ১৪ শতাংশ। এরমধ্যে গত ১১ জুলাই করোনায় একদিনে সর্বোচ্চ ২৩০ জনের মৃত্যু দেখেছে দেশ।

এ ছাড়া শনাক্তের দিক থেকেও একের পর এক রেকর্ড ভেঙেছে জুলাইয়ে। এই ১৩ দিনের মধ্যে শনাক্ত হয়েছেন এক লাখ ৪৬ হাজার ২৮০ জন। যা দেশের মোট শনাক্তের প্রায় ১৩ শতাংশ। শনাক্ত ও মৃত্যুর যখন এমন পরিসংখ্যান, তখন লকডাউন শিথিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কোন বিবেচনায়। এমন প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে গেলে - করোনা সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, এই সিদ্ধান্ত তাদের পরামর্শের উল্টো। এর ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সহিদুল্লা আরো বলেন, আমাদের কাজ করোনা মোকাবিলায় যা ভালো সেটা বলা। আমরা সেটাই করি। এরপর সরকার তার বিবেচনাপ্রসূত কাজ করছে। এখন পর্যন্ত করোনার নিম্নমুখী ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে না। লকডাউনটা ধরে রাখতে পারলে হয়তোবা দেখতাম। এক সপ্তাহ পর কিছুটা কমতো। হয়তো শনাক্তের হার ২৫-এর নিচে ও মৃত্যু ১৫০-এর নিচে কমে আসতো।

একজন। এর মধ্যে সব খুলে দেওয়া হলো। মানুষ এতদিন ঘরে ছিল বলে অনেকেই বের হবে একসঙ্গে। শতভাগ মানুষ মাস্ক পরছে না-এটা আমরা দেখে ফেলেছি, জেনে গেছি। তারা যখন একসঙ্গে বের হবে তখন ভাইরাস তার কাজ করে যাবে। একজন থেকে আরেকজনে ছড়াবে। যে কারণে আমাদের পরামর্শ ছিল-কঠোর বিধিনিষেধ আরো দুই সপ্তাহ চালানো। এতে ভালো অবস্থানে যেতে পারতাম।

কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, এ শিথিলতার সিদ্ধান্তে আমরা বিস্মিত, হতভম্ভ। সব খুলে দেওয়া হলো ১০দিনের জন্য। সরকার বলছে, শিথিল করা হলো। অথচ সব আগের অবস্থায় চলে যাবে। শিথিল এই বিধিনিষেধকে ‘ছলনা’র সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, আগামী ১০ দিনের শিথিলতায় বর্তমান অবস্থার আরও অবনতি যে ঘটবে, এতে সন্দেহ নেই।

কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এপর্যন্ত একদিনে মৃত্যু ২০০-২৩০ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এ অবস্থায় শিথিলতার কারণে সংক্রমণ আরও বাড়বে। নিশ্চিতভাবেই বাড়বে মৃত্যু। তাই যা হওয়ার সেটাই হবে। আমি এ মুহূর্তে আর কিছু চিন্তাও করতে ভয় পাচ্ছি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বললেন, এ ১০দিনের অবাদ চালাফেরায় হয়ত এখন সবাই সংক্রমিত হবো। কিছু হয়তো বেঁচে যাবেন। যারা এ দফায় সারভাইব করতে পারবেন না, তাদের হারাতে হবে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, সংক্রামনের যে অবস্থা তার মধ্যে শিথিল বিধিনিষেধ সংক্রমণ আরো বাড়াবে। গত ১৪ দিনের সর্বাত্মক বিধিনিষেধের ফলাফল দেখতে এখনো অপেক্ষা করতে হচ্ছে আমাদের, যা এখনো দৃশ্যমান নয়। আমি আশাবাদী ছিলাম, সংক্রমণ হয়তো কমতে শুরু করবে এর মধ্যে। সেটা তো হচ্ছে না।

তিনি বলেন, সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে আনুষ্ঠানিকভাবে। অনানুষ্ঠানিকভাবে আজকেই শিথিল হয়ে গেছে। ১০ দিন একটানা সব ছেড়ে রাখাটা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ারই শামিল।

অন্যদিকে এভাবে বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ায় শঙ্কায় খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর আগে করোনাভাইরাস সংক্রমণের চলতি গতি-প্রকৃতি দেখে সামনে করুণ অবস্থার শঙ্কা প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন গতকাল নিয়মিত বুলেটিনে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করে, এই বিধিনিষেধ শিথিল করা সাপেক্ষে আমাদের সংক্রমণ বৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এর আগে ডা. রোবেদ আমিনই গত রোববার বলেছিলেন, সংক্রমণ এখনো বেড়েই চলেছে। অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে, হাসপাতালের সমস্ত খালি বেড পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ হয়ে যাবে। তখন সবাই মিলে বিপদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে।

ডা. রোবেদ আমিন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন গণপরিবহন, বাজার ও পশুরহাট এবং শপিং মলগুলো খোলা রাখা হয়, সেটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বারবার কঠোরভাবে বলার চেষ্টা করছে। পরিবহনে যাত্রীর সংখ্যা অর্ধেক করা না হলে সংক্রমণের মাত্রা কমার কোনো সুযোগ থাকবে না। ঢাকায় ১৭ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত কোরবানির পশুরহাট বসবে, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বাড়তে পারে। তাই বিধি-নিষেধ শিথিল করা হোক বা না হোক, আমাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads