• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বেশি ঝুঁকিতে পঞ্চাশোর্ধ্বরা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ আগস্ট ২০২১

চলতি বছরের গত ৪ বা ৫ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হন গাজীপুরের বাসিন্দা ৭৮ বছরের আব্দুল মান্নান। সেখান থেকে চিকিৎসার জন্য তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানেই লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় ১৪ জুলাই তিনি মারা যান।

আব্দুল মান্নানের ভাগ্নে তারিকুল ইসলাম সজীব জানান, মামার গত ফেব্রুয়ারিতে মাইল্ড কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, সেখান থেকে কিছু জটিলতা তৈরি হয়। এছাড়া তিনি বয়সের তুলনায় সুস্থ ছিলেন, অন্য কোনো জটিলতা ছিল না।

তারিকুল ইসলামের খালুও মারা যান করোনা আক্রান্ত হয়ে। ঈশ্বরদীর বাসিন্দা ৭০ ঊর্ধ্ব জহুরুল ইসলাম অনেক দিন বয়সজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সেখানেই হাসপাতালে নেওয়া হলে তার মৃত্যু হয় বলে জানান তারিকুল ইসলাম।

পরিবারের দুই বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য মামা ও খালুকে হারিয়ে তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের একটা প্রজন্ম নাই হয়ে যাচ্ছে করোনায়, মাথার ওপরের ছায়াগুলো সরে যাচ্ছে।’

মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে মারা যাওয়ার সংখ্যাই বেশি। বিশেষ ৫০ ঊর্ধ্ব ব্যক্তিরাই মারা গেছে বেশি। গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত একদিনে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ২৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে সংক্রমণ ধরা পড়েছে ১০ হাজার ৪২০ জনের দেহে। আগের দিন মঙ্গলবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৬৪ জন; যা দেশে করোনা মহামারিকালে একদিনে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ৫ আগস্টও ২৬৪ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গতকাল জানায়, সরকারি হিসাবে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ২৩ হাজার ছাড়িয়েছে। এ সংখ্যা এখন ২৩ হাজার ৩৯৮। আর দেশে এ পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে ১৩ লাখ ৮৬ হাজার ৭৪২ জনের দেহে।

গতকাল মারা যাওয়া ২৩৭ জনের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিশোর্ধ্ব ৪, ত্রিশোর্ধ্ব ১৪, চল্লিশোর্ধ্ব ২৪, পঞ্চাশোর্ধ্ব ৪৬ ও ষাটোর্ধ্ব ৮৪, সত্তরোর্ধ্ব ৪৫, অশীতিপর ১৫ ও নবতিপর ২ জন।

গত মঙ্গলবার মারা যাওয়া ২৬৪ জনের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৯১ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে রয়েছেন পাঁচ জন, ৮১ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে ১২ জন, ৭১ থেকে ৮০ বছরের মধ্যে ৪৮ জন, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ৮৫ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ৬৬ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ২৫ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ১৬ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ছয় জন এবং শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে একজন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, মারা যাওয়া ২৩ হাজার ৩৯৮ জনের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০০ বছরের ঊর্ধ্বে রয়েছেন ২৮ জন; যা শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ, ৯১ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে ২৬৫ জন বা এক দশমিক ১৪ শতাংশ, ৮১ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে এক হাজার ২৬৮ জন বা পাঁচ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ৭১ থকে ৮০ বছরের মধ্যে চার হাজার ১০ জন বা ১৭ দশমিক ৩১ শতাংশ, ৬১ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে সাত হাজার ১৯৬ জন বা ৩১ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে পাঁচ হাজার ৪৯৯ জন বা ২৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে দুই হাজার ৭৭৪ জন বা ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে এক হাজার ৩৯৩ জন বা ছয় দশমিক ‍শূন্য এক শতাংশ, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৫২২ জন বা দুই দশমিক ২৫ শতাংশ, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ১৪২ জন বা শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ এবং শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে ৬৪ শিশু, যা শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ।

জানা যায়, গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিন জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় বলে জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তার ঠিক ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর ‍মৃত্যুর কথা জানায় সরকারের এই সংস্থাটি।

১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর কথা জানাতে গিয়ে আইইডিসিআরের তৎকালীন পরিচালক ও বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানিয়েছিলেন, বিদেশ থেকে আসা আত্মীয়ের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছিলেন ৭০ বছরের পুরুষ সেই রোগী। তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি সমস্যা ও হূদরোগে ভুগছিলেন।

তখন থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা আক্রান্ত হয়ে গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত শূন্য থেকে ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে দেশে সেটা গণমাধ্যমে পাঠাতো। গত ১৫ জুলাই থেকে অধিদপ্তর বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে আরো সুনির্দিষ্ট করে ষাটোর্ধ্ব থেকে বয়স বাড়িয়ে ১০০ ঊর্ধ্ব বয়সের ভেতরে কোন বয়সে কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে সেটাও পাঠাচ্ছে।

করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে সব সময়ই ৫১ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সিরাই বেশি। তাই তাদের ঝুঁকিপূর্ণ বলে শুরু থেকেই সতর্ক করা হচ্ছিল। এ জন্য দেশে করোনা টিকা দেওয়ার আগে ৫৫ ঊর্ধ্বদের তালিকায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে পরিচালিত হওয়া দেশের গণটিকাদান কর্মসূচিতে কয়েক ধাপে বয়স কমিয়ে আনা হলেও এখনো বয়োবৃদ্ধ নারী এবং প্রতিবন্ধীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, বিশেষ করে চলমান সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে। এমনকি টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে তাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ষাটোর্ধ্বদের মধ্যেই মৃত্যুর হার বেশি দেখা যাচ্ছে। তাই বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেক বেশি সতর্ক ও সচেতন থাকতে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকতে পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি ভিটামিন সি এবং জিংক সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি। তার মন্তব্য, শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়ামসহ মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হবে।

বাইরে বের হলে আবশ্যকভাবে মাস্ক পরতে বলেছেন অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা। তার পরামর্শ, বারবার সাবান পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়ার পাশাপাশি জনসমাবেশ এড়িয়ে চলতে হবে।

তিনি বলেন, ‘আপনার ওপর পরিবারের অন্যদের সুস্থ থাকা নির্ভর করছে। কাজেই সতর্ক ও সচেতন হোন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। পরিবারের শিশু ও বৃদ্ধসহ সবাইকে নিরাপদে রাখুন।’

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘বয়স্করা শুরু থেকেই করোনার ঝুঁকিতে ছিলেন। আর আক্রান্ত হলে তাদের মৃত্যু ঝুঁকিও সব সময়ই বেশি ছিল। আর এখনকার যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দেশে ছড়িয়েছে সেটা অতিসংক্রমণশীল এবং দ্রুত রোগীদের ক্ষতি করে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘যারা বৃদ্ধ তারা এমনিতেই বয়সের কারণে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত থাকেন, তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। এ কারণে করোনায় একবার যদি আক্রান্ত হয় তাহলে তাদের মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেশি বেড়ে যায়।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads