• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

সোনালি আঁশে নতুন দিগন্ত

বিনিয়োগে যাচ্ছে বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলো

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৪ আগস্ট ২০২১

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলো লিজ নেওয়ার চেষ্টা করছে দেশের কিছু বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী। প্রাণ, বে এবং আকিজ গ্রুপ পাটকলগুলোতে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। এ ছাড়া ভারতের দুটি এবং যুক্তরাজ্যের লন্ডনের একটি পাটকলও সরকারি পাটকলে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্র এসব জানায়। সূত্রটি জানায়, রপ্তানি সম্ভাবনা বাড়তে থাকায় গোষ্ঠীগুলোর এমন প্রবণতা।

এর মাঝেই আশার খবর, আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় চাষিদের অনাগ্রহে উৎপাদন কমে দেশে কাঁচা পাটের সংকটের শঙ্কার মধ্যে রপ্তানিতে আশা জাগিয়েছে গোল্ডেন ফাইবার। এরই মধ্যে, বিগত এক যুগের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ ১১৬.১৪ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে দেশের পাট ও পাটজাত পণ্য।

বাংলাদেশ থেকে এখন কাঁচা পাটের পাশাপাশি পাটের সুতা, দড়ি, ব্যাগ ও থলে এবং হাতে বাছাই করা আঁশ রপ্তানি করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় পাটের সুতা ও দড়ি পণ্য। পাট দিয়ে তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্য রপ্তানিও বেড়েছে।

এদিকে সম্প্রতি ১৪টি পাটকলের ইজারা পাওয়ার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে ২৪টি কোম্পানি মোট ৫৮টি দরপত্র জমা দিয়েছে। দরপত্র ছাড়া হয়েছিল ১৭টি পাটকলের জন্য।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইমরান আহমেদ বলেন, শীর্ষ ব্যবসায়ীরা ছাড়াও নতুন উদ্যোক্তারাও যৌথ উদ্যোগে আগ্রহ দেখিয়েছেন, যা খুবই ভালো লক্ষণ। তিনি আরও বলেন, আমরা আশা করছি এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে ইজারা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে পাটকলগুলো আগামী বছরের শুরুর দিকে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চালু হবে।

প্রাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা বলেন, আমরা বাংলাদেশ থেকে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করে অনেক আলু রপ্তানি করি। বিভিন্ন দেশে শপিং ব্যাগও রপ্তানি হয়। বিদেশি ক্রেতারা এখন পাটের ব্যাগ চাচ্ছে। এ ছাড়া জুট ডাইভারসিফাইড পণ্য রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। শপিং ব্যাগের পাশাপাশি পাট দিয়ে নানা ধরনের প্রোডাক্টস তৈরির পরিকল্পনা করছি। যেমন জুট ব্যাট প্লান্টেশন নতুন টেকনোলজি, এটা বিশ্বে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ফলে বিদেশে প্রচুর রপ্তানি করতে পারব।

জানা যায়, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে বিজেএমসি’র নিয়ন্ত্রণাধীন পাটকল ছিল ৩২টি। এর মধ্যে ৫টি পাটকলের মামলা আদালতে বিচারাধীন ছিল। ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চালু ছিল ২৬টি পাটকল। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, নরসিংদীর ঘোড়াশালে অবস্থিত বাংলাদেশ জুট মিলসের ইজারা পাওয়ার জন্য আবেদন জমা পড়েছে সবচেয়ে বেশি। পাটকলটি ঢাকার কাছাকাছি বলে এর জন্য বেশি আবেদন পড়েছে। বাংলাদেশ জুট মিলসের ইজারা পাওয়ার জন্য ১১টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। পাটকলটি ১৯৬২ সালে ৭৭ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয়।

সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পাওয়া কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে চূড়ান্ত প্রস্তাব পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় সে প্রস্তাব মূল্যায়ন করবে। তারপর কারিগরি ও আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে ইজারাদারদের চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করবে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ইমরান আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলোকে বেসরকারিকরণের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত সময়োপযোগী। এর ফলে দেশে ও বিদেশে পাট শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় লোকসান দিতে থাকা এই পাটকলগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়াটা ভালো সিদ্ধান্ত। কারণ ভালো ব্যবস্থাপনার অধীনে বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো ভালো করছে। ভারতের মোহন জুট ও প্যাসিফিজ জুট এবং লন্ডনের জুট রিপাবলিক ইজারা পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে। পূর্বে রায়গড় জুট মিল নামে পরিচিত মোহন জুট রায়গড়ে অবস্থিত। এটি হেসিয়ান বস্তা, কার্পেট ব্যাকিং, জুট সয়েল সেভার ও ইয়ার্ন উৎপাদন করে।

বিজেএমসির তথ্য অনুযায়ী, সরকারি পাটকলগুলোর মোট সম্পদের পরিমাণ ২৫ হাজার ৩৫২.৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ রয়েছে। স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে জমি, ভবন, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি, আসবাবপত্র, পরিবহন যানবাহন ইত্যাদি।

ঢাকার পাটকলগুলোতে সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৯৮৪.৪১ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ আছে। চট্টগ্রামের পাটকলগুলোর স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৪ হাজার ৪৩৫.২৯ কোটি টাকা এবং খুলনার পাটকলগুলোর স্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৪ হাজার ৪ হাজার ৬৬৬.১৯ কোটি টাকা। নন-জুট মিলগুলোর স্থাবর সম্পদ রয়েছে ২৪৪.০৭ কোটি টাকার।

২০২০-২১ অর্থবছরে পাট রপ্তানি রেকর্ড ৩১% বৃদ্ধি : বিজেজিইএ চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, বিদেশে বিগ ভলিউমে পাট রপ্তানি হয় কমার্শিয়াল আইটেম, যা হচ্ছে জুট ইয়ার্ন ও জুট ব্যাগ ইত্যাদি। দেশের বাজারেও এই পণ্যের ব্যবহার বেশি। মেজর এই খাতের সঙ্গে এখন পাটের বাই-প্রডাক্টও রপ্তানি হচ্ছে। এই ডাইভারসিফাইড বা ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যও রপ্তানি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের প্রায় ১৩৫টি দেশে ২৮২টি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়। বিগত বছরের তুলনায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ; যদিও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ০.৪৭ শতাংশ কম।

২০২০-২০২১ অর্থবছরে পাট রপ্তানি হয়েছে ১১৬.১৪ লাখ ডলার, যা টাকার অংকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালের পর এবারই পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে এক বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে।

ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বিগত ১২ বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে চারবার। প্রথমবার ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ১১১.৪৯ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়। দ্বিতীয়বার ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ১০৩.০৬ কোটি ডলার, তৃতীয়বার ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১০২.৫৫ কোটি ডলার ও সর্বশেষ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১১৬.১৪ কোটি ডলার।

কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে ১৩.৮১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬% বেশি। জুট ইয়ার্ন এবং টোয়াইন আগের বছরও রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৫ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ৭৯.৯০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬.৫৪ শতাংশ বেশি।

পাটের ব্যাগ ও থলে রপ্তানি বেড়েছে ৩০ শতাংশ, অন্যান্য পণ্য ৫% এবং হাতে বাছাই করা পাটের আঁশ ও স্ট্যাপল ফাইবার রপ্তানি বেড়েছে ১০ শতাংশ।

কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮২ লাখ ৮৩ হাজার টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যেখান থেকে ৭৪ লাখ টন পাট পাওয়া গেছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৫ লাখ ৭৬ হাজার টন পাট উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮০ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৮৬ লাখ টন কাঁচা পাট উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন কৃষি অধিদপ্তর।

মোনামী জুট মিলের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আলী আলফি সানী আকাশ বলেন, সরকার যদি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি বন্ধ না করে এবং কালোবাজারিদের কাঁচা পাট পাচার রোধ ও ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণ না করে তাহলে এবারও চাহিদার তুলনায় ৫-১০ লাখ বেল পাটের সংকটে পড়বে। এছাড়াও বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারি ১৭টি পাটকল যদি পিপিপি’র মাধ্যমে এ বছর নতুন করে চালু হলে ওই পাটকলগুলোরও অনেক পাটের প্রয়োজন হবে। তাই আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি দেশীয় পাটকলগুলোর চাহিদা আগে নিশ্চিত করতে, ডিসেম্বর পর্যন্ত কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি বন্ধ রাখতে।

তুলিকার প্রধান নির্বাহী ইশরাত জাহান বলেন, কাঁচা পাট পাচার, সিন্ডিকেট ও ফড়িয়াদের কারণে গত বছর তিনগুণ বেশি দামে ফেব্রিক্স কিনতে হয়েছে, ফলে বেশি দামে পণ্য রপ্তানি করায় আমাদের রপ্তানি ভলিউম কমেছে অনেক। রপ্তানি আয় বাড়লেও তাতে আমাদের লাভ হচ্ছে না।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিউটের তথ্যমতে, ১৯৯০-এর দশকে দেশে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও চাষ হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে। ফরিদপুর, যশোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, জামালপুর এবং ঢাকা জেলায় পাট সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়।

কৃষির অ্যাডিশনাল ডেপুটি ডিরেক্টর (কন্ট্রোল রুম) খন্দকার এম. রাশেদ ইফতেখার বলেন, এই বছর ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে দেশে পাটের পর্যাপ্ত ফলন হয়েছে। কৃষক পর্যায়েও কোনো ধরনের অভিযোগ পাইনি। আশা করি গত বছরের তুলনায় এবার ফলন বেশি হবে, পাটের কোনো সংকট হবে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বীজ ও অন্যান্য উপকরণ) ড. সুরজিত সাহা রায় বলেন, আগামী ৫ বছরেই পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ। প্রতি বছর ভারত থেকে সাড়ে ৪ হাজার টন বীজ আমদানি করা হয়। আগামী ২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬ এই ৫ অর্থবছরের মধ্যে দেশে ৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পাটবীজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে দেশে আর কোনো পাটবীজ সংকট হবে না; আমদানি নির্ভরতাও থাকবে না।

বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) তথ্যমতে, সারা দেশে ২৯১টি জুট মিল রয়েছে, যার মধ্যে ৫৪টি বন্ধ। এসব মিলে গড়ে ৭৮ লাখ বেল জুট উৎপাদন হয়। দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৬৫ লাখ বেল আর বিদেশে রপ্তানি হয় ১৪ লাখ বেল।

সংগঠনটির হিসাবমতে, বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় রয়েছে ৯৪টি পাটকল, যার মধ্যে ১২টি বন্ধ। বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) আওতায় রয়েছে ১৬৫টি মিল, যার মধ্যে ৪২টি বন্ধ। আর বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতায় রয়েছে ৩২টি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads