• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯
মানহীন মাস্কে ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

#মানহীন মাস্কে সয়লাব বাজার *তৈরি হচ্ছে ফলস সিকিউরিটি

মানহীন মাস্কে ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৫ আগস্ট ২০২১

প্রায় দেড় বছর ধরে মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের থাবায় ভেঙে পড়ার উপক্রম স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার। এই করোনা থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহারেই সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন দেশি-বিদেশি প্রায় সব বিশেষজ্ঞ। সরকারও দেশজুড়ে বেশ কয়েকবার লকডাউন দিলেও সংক্রমণ প্রতিরোধে বার বার সাধারণ মানুষকে মাস্ক ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে। তাই নিত্য ব্যবহার্যের তালিকায় এখন জায়গা করে নিয়েছে মাস্ক। কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, সংক্রমণ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর ও অপরিহার্য এই মাস্কের গুণগত মান নিশ্চিতে এখনো কোনো পদক্ষেপ প্রশাসন। ফলে মানহীন মাস্কে সয়লাব হয়ে গেছে সারা দেশ। আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার পরিবর্তে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

যদিও গত বছর করোনা সংক্রমণের শুরুতে নকল মাস্কসহ স্যানিটাইজারসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য বেচাকেনা বন্ধে বেশ তৎপরতা দেখিয়েছিল অইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। কিন্তু তাদের সেই তৎপরতা এখন আর দেখা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাজারে এখন যেসব মাস্ক বিক্রি হচ্ছে এর বেশিরভাগই ব্যবহারকারীকে ধুলাবালি থেকে রক্ষা করতে সক্ষম, করোনা থেকে নয়। প্রকৃত মাস্ক এমনভাবে তৈরি হবে, যেন এগুলো দিয়ে সহজে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া যায়। কিন্তু যেসব মানহীন মাস্ক বিক্রি হচ্ছে তার অধিকাংশ দিয়েই শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এছাড়া এসব নকল মাস্ক ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে ফলস সিকিউরিটি, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকার মাস্ক ব্যবহার বাধ্যকতামূলক করায়, এখন বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়,‘মাস্ক নাই সেবা নাই’-এই স্লোগান। ফলে এখনো ব্যাপক চাহিদা রয়েছে মাস্কের। একই সঙ্গে বেড়েছে সরবরাহ। কিন্তু যে সব কারখানায় মাস্ক তৈরি হচ্ছে বা যারা মাস্ক আমদানি করছেন সেখানে নেই কোন তদারকির ব্যবস্থা। আর কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন না থাকায় ইচ্ছেমতো নামে-বেনামে তৈরি হচ্ছে এই মাস্ক। মুনাফা বেশি হওয়ায় ফুটপাতেও বিক্রি হচ্ছে মানহীন এসব মাস্ক।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, মানহীন নকল মাস্কে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। মাস্ক ও স্যানিটাইজারের ব্যাপারে নীতিমালা করার কথা থাকলেও এখনো হয়নি। স্যানিটাইজারের নীতিমালা প্রণয়ন করবে ঔষধ প্রশাসন ও মাস্কের ব্যাপারটা দেখবে বিএসটিআই। দেশে এখনো মাস্ক তৈরির কোনো বাধ্যতামূলক কাঠামো নেই। বিএসটিআইয়ের ওয়েবসাইটে যে তালিকা রয়েছে তাতে ১৮১টি পণ্যের মধ্যে মাস্ক নেই।

মানহীন মাস্ক নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েই প্রকাশ করেছেন তাদের শঙ্কার কথা। আব্দুল করিম নামে এক ব্যক্তি জানান, মাস্ক না পড়ার দরুন সাধারণ মানুষদের শুধু জরিমানা করলে হবে না। বাজারে নকল মাস্ক যারা বিক্রি করছে তাদের দোকানেও অভিযান পরিচালনা করা জরুরি।

মিরপুরের বাসিন্দা মির্জা হাফিজ বলেন, একটা নিয়ম থাকা দরকার যে কোথায় মাস্ক বানানো হবে, কারা উৎপাদন করবে। তা না হলে দেখা যাবে এসব মাস্ক ভাইরাস প্রতিরোধ নয়, সংক্রমণ বাড়াবে।

যাত্রাবাড়ী এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী আনিস বলেন, বাজারে এখন মানহীন মাস্কের ছড়াছড়ি। দু-একটি কোম্পানি ছাড়া সবাই যেমন-তেমন মাস্ক বিক্রি করছে। এজন্য একটা নীতিমালা থাকা দরকার। আমরা প্রতি পিস মাস্ক খুচরা পাঁচ টাকা করে বিক্রি করছি, আবার কেউ তিনটা মাস্ক ১০ টাকায়ও বিক্রি করছে। সুতরাং মানের তো পার্থক্য অবশ্যই আছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজারে এখন যে মাস্কগুলো পাওয়া যাচ্ছে এর বেশির ভাগই বড়জোর ব্যবহারকারীকে ধুলাবালি থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম। কিন্তু এগুলো ভাইরাস প্রতিরোধে অকার্যকর। বাজারে যেসব মাস্ক বিক্রি হচ্ছে সেগুলোতে যেদিক দিয়ে বাতাস ফিল্টার হয়ে ঢোকার কথা সেখানে ফিল্টার পেপার নেই। বরং সাদা বক্স বরাবর অংশে কাপড় দেওয়া। ফিল্টার পেপারের বদলে শক্ত ফোম দিয়ে মাস্ক তৈরি করা হচ্ছে। অথচ একটি ভালো মাস্কে যে ফিল্টার পেপার ব্যবহার করা হয় তা কমপক্ষে পিএম ২.৫ মানের। এটি দেখতে অনেকটা রাবারজাতীয় এবং এতে থাকা ছিদ্রকে মাইক্রোপোর বলে। বাতাসে থাকা ভাইরাস এই ছিদ্রের ফাঁকে আটকে যাওয়ার কথা। কিন্তু নকল মাস্কগুলোর ভাইরাস আটকানোর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ আছে।

এছাড়া এক শ্রেণির ব্যবসায়ী লাভের আশায় শপিং ব্যাগে ব্যবহূত পেপার দিয়ে যেনতেনভাবে ভেন্টিলেশন ক্যাপ লাগিয়ে মাস্ক তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছেন। এই মাস্কগুলোর অনেকগুলো নন-ওভেন কাপড় দিয়ে তৈরি, যা অত্যন্ত নিম্নমানের। আর এর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হচ্ছে প্লাস্টিকের ফিল্টার। অথচ ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কর্তৃপক্ষের মতে, সাধারণ সার্জিকাল মাস্ক এবং এন ৯৫ মাস্কগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন এগুলো দিয়ে সহজে শ্বাস নেওয়া যায়। কিন্তু দেশে যেসব মাস্ক পথেঘাটে বিক্রি হচ্ছে তা দিয়ে ব্যবহারকারীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, বাজারে সার্জিক্যাল মাস্ক, সুতি কাপড়ের মাস্ক, কেএন ৯৫, কেএন ৭৫সহ বেবি মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব পণ্য তৈরি হচ্ছে রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর, বাড্ডা, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়।

এদিকে নকল স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ব্যবহার করলে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায় বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী। তিনি বলেন, যখন কেউ নকল পণ্য কিনে তা ব্যবহার করবেন, তখন তিনি ভাববেন যে তিনি সুরক্ষিত আছেন, তার হাত জীবাণুমুক্ত আছে। এতে ফলস সিকিউরিটি তৈরি হবে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। ঝুঁকি এড়ানোর জন্য ফুটপাত বা যে-কোনো জায়গা থেকে সুরক্ষাসামগ্রী না কিনে ফার্মেসি বা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে কেনার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী। তিনি বলেন, মানুষকেও সচেতন হতে হবে। রাস্তাঘাটে অনেক কবিরাজির ওষুধও পাওয়া যায়। এগুলো কেনা যাবে না। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মতো পণ্য ফার্মেসি থেকে কেনা নিরাপদ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads