• শনিবার, ৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-কিশোররা

আরো ১৮৯ রোগী হাসপাতালে

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১

দেশে করোনা সংক্রমণের নিম্নমুখী প্রবণতার মাঝে বাড়ছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগী। বিগত কয়েকদিনের আক্রান্ত বিবেচনায় দেখা গেছে বড়দের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও কিশোররা। বাইরে খেলতে বেরিয়ে অসচেতনতায় তারা আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন অভিভাবকরা।

এর মাঝে মাস খানেকের মাঝে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। আবার প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে জানিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, সবাই মিলে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। বিপরীতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে বলে জানিয়েছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৬ হাজার ৮৯৪ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে ১৫ হাজার ৭৮৭ জন রোগী। ডেঙ্গুতে এ সময়ে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবশেষ গত একদিনে দেশে নতুন করে আরো ১৮৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৬৪ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৫ জন।

গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দিনে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন ১৮৯ জন ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪৮ জন। এর মধ্যে ঢাকার ৪৫টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছে ৮২৭ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে ২২১ জন।

এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বিগত এক দিনে হাসপাতালে ভর্তি ২৫৪ জনের মধ্যে ২৪ দশমিক ৭ শতাংশেরই বয়স ১০ বছরের মধ্যে; এর মধ্যে ২ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর বয়স এক বছরের মধ্যে। এদিন চিকিৎসা নিতে আসা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২২ দশমিক ১ শতাংশ রোগীর বয়সসীমা ১১ থেকে ২০ বছর।

এনিয়ে গত সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার টানা চারদিন ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী পেয়েছে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলো।

আগের দিন বুধবার ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর বয়স ছিল ১০ বছরের মধ্যে, এর মধ্যে ৩ দশমিক ২ শতাংশ শিশুর বয়স এক বছরের কম। এ ছাড়া ২০ দশমিক ৬ শতাংশ রোগীর বয়সসীমা ছিল ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে।

এর আগে মঙ্গলবার সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ ও সোমবার ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর বয়স ১০ বছরের মধ্যে থাকার তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ তথ্য শুধু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের। এর বাইরেও প্রচুর মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন, যারা বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে চিকিৎসকরা বলছেন। 

গত বুধবার ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, অনেক শিশুর হাতেই ছিল ক্যানুলা, বেডের স্ট্যান্ডে ঝুলছিল স্যালাইনের ব্যাগ। এ সময় ছোট্ট হাতে ক্যানুলা নিয়ে নিশ্চুপ শুয়ে ছিল দুই বছর বয়সী হাফসা। কয়েকদিনের জ্বরে কুঁকড়ে গেছে তার এতটুকু শরীর। হাসপাতালে সঙ্গে থাকা মা ইতি নিজেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা ইতি জানান, গত বছর হাফসা ছাড়া পরিবারের সবাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। এবার পরিবারের অন্য কেউ আক্রান্ত হননি। তিনি বলেন, ওর ১০২, ১০৩, ১০৪ এর মতো জ্বর ছিল। জ্বর একেবারেই কমছিল না। পরে তো পরীক্ষা করায় ডেঙ্গু ধরা পড়ল।

এ হাসপাতালে যখন ভর্তি হতে আসে তখন কাফরুলের নয় বছর বয়সী সুবাইতার অবস্থাও ছিল নাজুক। গত শনিবার থেকে জ্বর, বমি, মাথাব্যথা, পেটব্যথা, পাতলা পায়খানায় ভুগছিল সে। তার মা অনিলা আক্তার জানান, চিকিৎসকের কাছে নেওয়ার পর সুবাইতা সেখানেই বমি করে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। এরপরই ডেঙ্গুর পরীক্ষা করিয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন চিকিৎসক। শিলা আক্তার বলেন, ও কোচিংয়ে যায়, বাসার নিচে খেলাধুলা করে। কখন যে মশা কামড়াল, আমরা জানি না। হঠাৎ করে জ্বর আসল; বমি, পাতলা পায়খানা শুরু হলো। তারপর টেস্ট করে দেখলাম ডেঙ্গু।

মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের তৎপরতা নিয়ে অসন্তুষ্ট উত্তরার এ বাসিন্দা বলেন, আমরা বাসা যতই পরিষ্কার রাখি, বাড়ির আশপাশে, রাস্তাঘাটে তো মশার ওষুধ ছিটানোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তাদের তো সেই দায়িত্বটা পালন করতে হবে।

আরেক শিশু তাইফের মা রোকেয়া ডেঙ্গু ঠেকাতে সবাইকে সচেতন হওয়ার তাগিদ দিয়ে বলেন, শুধু আমি তো বাসা পরিষ্কার রাখলেই হবে না। সবাইকে রাখতে হবে।

নয় দিন ধরে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা মিরপুরের পাইকপাড়ার ছয় বছর বয়সী ফাহিমের মা খাদিজা বেগম জানান, তার ছেলের প্রচণ্ড জ্বর ছিল, যা কমছিলই না। তিনি বলেন, ১০৩ এর নিচে জ্বর নামছিলই না। সাপোজিটরি দিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট ঠিক থাকার পর আবার জ্বর উঠতে। পরে ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখল ডেঙ্গু হয়েছে। প্লেটলেইট কমে গিয়েছিল, তখনই হাসপাতালে ভর্তি করি।

ফাহিমের ভাই হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের বাসাটা মধ্য পাইকপাড়ায়। পাশেই একটা বিল্ডিং করার জন্য মাটি খুঁড়ে রাখছে, ওখানে পানি জমে আছে। আমার মনে হয় ওখান থেকেই ডেঙ্গু মশার উৎপত্তি। ওখানে সিটি করপোরেশনের মশানিধনের কার্যক্রম নাই বললেই চলে। হয়ত মাসে একদিন আসল, এরকম।

জরুরি বিভাগের দায়িত্বে চিকিৎসক সাথী সুলতানা রিমা জানান, আগস্ট থেকে প্রচুর ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছেন তারা, যাদের বেশিরভাগই ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। তিনি বলেন, তারা জ্বর নিয়েই বেশি আসছে। কেউ কেউ বমি, মাথাব্যথা, পাতলা পায়খানার সমস্যা নিয়ে আসছে। যাদের অবস্থা খারাপ, তাদের আমরা ভর্তি নিচ্ছি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ বলেন, আমরা চিরুনি অভিযান চালাচ্ছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্য দিচ্ছে। সে অনুযায়ী বিভিন্ন বাসার আশপাশে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আগে মানুষ সচেতন ছিল না। এখন কিছুটা হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান জানিয়েছেন, তারা প্রতি এলাকায় এক সপ্তাহ পর পর মশক নিধন কর্মসূচি চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা অনেক ব্যবস্থাই নিচ্ছি, সবকিছু মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী মনে করেন, ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের দিনের অধিকাংশ সময়ই শরীরের বেশিরভাগ অংশ খোলা থাকে বলে তারা মশার আক্রমণের শিকার হচ্ছে বেশি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘প্রকৃতিকে ধ্বংস করার কারণেই প্রকৃতি এখন প্রতিশোধ নিচ্ছে। তাই প্রকৃতিকে আর ধ্বংস নয়; সবাই মিলে রক্ষা করতে হবে।’

গতকাল শুক্রবার রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা : সমস্যা ও প্রতিকার’ শীর্ষক সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন। আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডিএনসিসি এলাকার রিটেনশন পন্ডে বায়ো ইকো পার্ক গড়ে তোলা হবে। হাতিরঝিলের মতো একটি জলাধার দিয়ে কখনও নগরীর জলাবদ্ধতা সমাধান করা সম্ভব নয়। এই সমস্যা সমাধানে সুপরিকল্পিত একাধিক জলাধার প্রয়োজন।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে বলে জানিয়েছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। গত বুধবার নিউ মার্কেট এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, গত কিছুদিন ধরে ডিএসসিসি এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ এর নিচে নেমেছে। গত পাঁচদিনে ডিএসসিসি এলাকায় ডেঙ্গু ১৮ শতাংশের নিচে। সামগ্রিক ৩০ শতাংশের কম। ডেঙ্গু এখন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে, ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার সুযোগ নেই।

এদিকে মাসখানেকের মধ্যে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা করছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। মশা দমনে নিয়মিত কাজ চলার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি আশাকরি, মাসখানের মধ্যেই এডিস মশা একটি সহনশীল জায়গায় চলে আসবে।

গত বৃহস্পতিবার সোনারগাঁও হোটেলে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, অনেকেই বাসাবাড়ি ছেড়ে নিজ এলাকায় যাওয়ায় এবং নির্মাণ শ্রমিকরা ছুটিতে থাকায় এডিস মশা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads