• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

জাপান যেতে চেয়েছিল ৩ ছাত্রী

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০২১

করোনাকালে দীর্ঘদিন ঘরে আবদ্ধ। এর মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক নানা নিয়মনীতি মানতে পরিবারের চাপ। এসব কিছুই ভালো লাগে না তাদের। আগ্রহ হারিয়ে ফেলে পড়াশোনায়ও। চায় স্বাধীন জীবনযাপন। একঘেয়েমি কাটাতে ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে শিল্পোন্নত জাপানি তরুণ-তরুণীদের স্বাধীন জীবনব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ওঠা। সেজন্য তারা শিখছিল জাপানের ভাষাও। এরপর জাপান যেতে ঘর ছাড়া।

পল্লবীর বহুল আলোচিত টাকা, স্বর্ণালংকার ও সার্টিফিকেট নিয়ে নিখোঁজ হওয়া ৩ কলেজছাত্রীকে উদ্ধারের পর এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।

প্রায় এক সপ্তাহ নিখোঁজ থাকার পর তাদের উদ্ধার করে র‍্যাব। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য পেয়েছেন র‍্যাবের কর্মকর্তারা।

র‌্যাব বলেছে, ওই ৩ কলেজছাত্রীকে লেখাপড়ার জন্য ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার জন্য চাপ দিতো পরিবার। এতে পরিবারের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়ে তারা। করোনাকালে দীর্ঘদিন বাসায় আবদ্ধ থাকার সময় তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি বিশেষ করে জাপানী সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পরে। এভাবে জাপানী সংস্কৃতিতে নারী পুরুষের সম-অধিকার, স্বাধীনতা, দত্তক হওয়ার সুযোগ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি আকৃষ্ট করে তাদের। এতে দেশ ছেড়ে স্বাধীন জীবন-যাপন ও উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে তারা। আর এ জন্য জাপানী সিনেমা-সিরিয়াল, সাংস্কৃতিক প্রোগাম দেখে জাপানী ভাষায় কিছুটা আয়ত্বও করে নেয় তারা।

বুধবার রাতে গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।

র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, গত ৩০ সেপ্টেমবর সকাল সাড়ে ৯ সেপ্টেম্বর সময় পল্লবী থানাধীন এলাকার নিজ নিজ বাসা থেকে স্নেহা আক্তার (১৬), কাজী দিলখুশ জান্নাত নিশা (১৫) এবং কানিজ ফাতেমা (১৬) নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার ও নিজেদের সার্টিফিকেট নিয়ে বেরিয়ে যায়। কেউ যাতে সন্দেহ না করে, সেজন্য কলেজ ড্রেস ও ব্যাগ নিয়ে বের হয় তারা।

এ ঘটনায় ২ অক্টোবর রাতে নিখোঁজ শিক্ষার্থী দিলখুশ জান্নাত নিশার বড় বোন অ্যাডভোকেট কাজী রওশন দিল আফরোজ বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় তিনি আসামি করেন- মো. তরিকুল্লাহ (১৯), মো. রকিবুল্লাহ (২০), জিনিয়া ওরফে টিকটক জিনিয়া রোজ (১৮) ও শরফুদ্দিন আহম্মেদ অয়নকে (১৮)।

এ ঘটনায় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াসহ পুরো দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। যার প্রেক্ষিতে পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব-৪ এর একটি গোয়েন্দা দল এ বিষয়ে ছায়া তদন্ত শুরু করে। গোপন তথ্যের সহায়তায় এবং কক্সবাজারে থাকা র‌্যাব-৪ এর টিমের মাধ্যমে জানতে পারে নিখোঁজরা গত ৫ অক্টোবর রাত ৯ টায় ছদ্মবেশে কক্সবাজার থেকে বাসযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হয়। প্রাপ্ত গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৪ এর একটি অভিযানিক দল ৬ অক্টোবর সাড়ে ৪ টায় সময় আবদুল্লাহপুর বেড়িবাধ এলাকা থেকে ওই তিন ছাত্রীকে উদ্ধার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে তারা জানায়, তারা ৩ জন বান্ধবী এবং তারা মিরপুরের স্থানীয় কলেজে লেখাপড়া করে। তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন অপসংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পরে। দিনদিন লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যার ফলশ্রুতিতে তাদের পরিবার পড়ালেখার জন্য ও ধর্মীয় বিধিবিধান মেনে চলার জন্য চাপ দিত। অতিরিক্ত পারিবারিক এ বিধিনিষেধের ফলে তারা পরিবারের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়ে।

র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, তাদের নিজেদের পরিবারের নিয়ম-কানুন ভালো লাগত না এবং এসব সামাজিক ও ধর্মীয় নিয়মকানুন তাদের কাছে অত্যাচার মনে হতো। তারা মূলত উচ্চাবিলাসী জীবন-যাপন পছন্দ করত। দীর্ঘদিন বাসায় আবদ্ধ থাকার সময় তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি বিশেষ করে জাপানী সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পরে। তারা অধিক পরিমানে জাপানী সিনেমা-সিরিয়াল, সাংস্কৃতিক প্রোগাম দেখে দেখে জাপানী ভাষায় কিছুটা আয়ত্ব করে নেয়। তারা দেশ ছেড়ে স্বাধীন জীবন-যাপন ও উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে জাপান যাওয়ার পরিকল্পনা করার কারণ হিসেবে জাপানী সংস্কৃতিতে নারী পুরুষের সম-অধিকার, স্বাধীনতা, দত্তক হওয়ার সুযোগ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ না থাকার কারণ উল্লেখ করে।

র‌্যাব জানায়, গত ২ মাস আগে এই তিন বান্ধবী বন্ধু তরিকুলের সঙ্গে দিয়াবাড়ী এলাকায় ঘুরতে গিয়ে হাফসা চৌধুরী নামের ২৪/২৫ বছরের এক নারীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। এরপর আলোচনার এক পর্যায়ে তারা জাপানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে হাফসা চৌধুরী তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। তিন বান্ধবী হাফসার সঙ্গে পরিকল্পনা করে কক্সবাজার রুট দিয়ে নৌপথে জাপান যাওয়ার উদ্দেশ্যে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯ রিকশা করে প্রথমে গাবতলী যায়।

অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, হাফসার পরামর্শে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের অবস্থান চিহ্নিত না করতে পারে সেজন্য তারা নিজেদের ইমেইল, ফেইসবুক আইডি এবং ব্যবহৃত মোবাইল গাবতলী এলাকায় ধ্বংস করে। পরবর্তীতে তারা নৌকা করে নদী পার হয়ে আমিন বাজার এলাকায় পৌঁছে। সেখান থেকে হাফসার ২ জন লোক একটি কালো রঙের নোয়াহ কার যোগে অচেনা একটি জায়গায় নামিয়ে দিয়ে সিএনজি করে তাদের কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে ট্রেনে করে চট্টগ্রামে যাওয়ার পরামর্শ দেয়।

তিনি আরও বলেন, তিন বান্ধবী তাদের কথামত কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে চট্টগ্রাম গামী কোন রেল না পাওয়ায় কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বাসে করে কুমিল্লা ময়নামতি যায়। এর মধ্যে পথেই তারা নিজেদের পরিচয় গোপনের উদ্দেশ্যে এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির আদলে নিজেদের চুল কেটে পশ্চিমা বেশ-ভুষণ ধারণ করে। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পৌঁছে তারা কেডস, পোষাক এবং একটি মোবাইল কেনে। সেখান থেকে তারা পুনরায় বাসে করে চট্টগ্রাম সিনেমা প্লেস বাসস্ট্যান্ডে যেয়ে দুইটি মোবাইল কিনে বাসে করে কক্সবাজারে যায়।

মোবাইল কিনলেও আত্মগোপনে থাকার জন্য তারা কোন সিম কেনা থেকে বিরত থাকে। কক্সবাজার পৌঁছে তারা ১ অক্টোবর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজার কলাতলিতে একটি হোটেলে অবস্থান করে সিমের পরিবর্তে ওয়াইফাই ব্যবহার করে। এরপর ২ অক্টোবর তারা কক্সবাজার বিচ এলাকায় বেড়াতে গেলে হাফসার লোক পরিচয়ে আসিফ এবং শফিক নামের ৩০/৩২ বছরের দুই ব্যক্তি তাদের কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও কিছু নগদ টাকা নিয়ে নেয়।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনার পর তারা আতংকিত হয়ে হোটেল চলে আসে এবং সেখানেই অবস্থান করে। এরপর হোটেলের আশেপাশে র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ৫ অক্টোবর রাত ৯ টায় ছদ্মবেশে বাসে করে কক্সবাজার থেকে রওনা হয়ে ঢাকার আব্দুল্লাহপুর পৌঁছলে বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে ৬ অক্টোবর ভোররাতে র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল তাদের উদ্ধার করে র‌্যাব-৪ এর কার্যালয়ে নিয়ে আসে।

হাফসা নামের ওই নারীর কথা জানতে চাইলে র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক সিও বলেন, কোন ফেইসবুক, ই-মেল আইডি শনাক্ত করতে না পারায় হাফসা নামের ওই নারীকে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

হাফসাকে শনাক্ত, গাড়িতে থাকা ২ ব্যক্তি এবং কক্সবাজারের বীচ এলাকায় স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়া ২ ব্যক্তিসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads