• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ভাসানচরে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা

রোহিঙ্গাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাচ্ছে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ অক্টোবর ২০২১

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর সঙ্গে দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের চুক্তির কারণে ভাসানচরে চিত্র বদলে যেতে শুরু করেছে। সেইসাথে জাতিসংঘের এই সংযুক্তির ফলে ভাসানচরে যেতে রোহিঙ্গাদের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন অনেক রোহিঙ্গাই স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাবে বলে মনে করছেন রোহিঙ্গা নেতা ও সরকার সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ খুনের পর কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগছে অনেক রোহিঙ্গা। এরকম প্রেক্ষাপটে ভাসানচরে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা সেখানে যেতে উৎসাহ বোধ করছে রোহিঙ্গারা। তবে ভাসানচরের চেয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের আরো উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন রোহিঙ্গা নেতারা। তাদের মতে, জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকার যেখানেই তাদের পাঠাবে, সেখানেই তারা যাবেন। তবে মিয়ানমারে ফিরতে বেশি আগ্রহী তারা।

ভাসানচরে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততায় রোহিঙ্গারা যে খুশি হয়েছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে গত শনিবার এ বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের পরদিন রোববার আনন্দ মিছিল করে সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। তারা ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে আনন্দ উচ্ছাস প্রকাশ করে। পরে তারা রোহিঙ্গা ভাষায় গান ও কবিতা পরিবেশন করে। মিছিলে নানা বয়সের মানুষরা অংশ নেন। বিভিন্ন ক্যাম্পের নেতারা তখন উপস্থিত ছিলেন। তারা বলেন, এমন একটি দিনের প্রতিক্ষায় ছিলেন সবাই। এখন আর কেউ ভাসানচর ছেড়ে পালাবে না। আর কক্সবাজার থেকে আসতেও কেউ আপত্তি করবে না।

 রোহিঙ্গা নেতা নুর বসর বলেন, আমি চেষ্টা করছি আমার আশপাশে যারা রয়েছে তাদের বুঝানোর। আমরা জানি বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ সর্বোচ্চ ভালোটাই চায়। তবে ভাসানচর নিয়ে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু বিষয়ে ভুল ধারণা রয়েছে। তারা অনেকেই ভাবে ভাসানচরে গেলে কোনো সাহায্য পাবে না, তবে জাতিসংঘ সেখানে যাওয়াতে এখন এই ভুলটাও তাদের ভেঙে যাবে। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে নিজেরা বিষয়টা আলাপ করছি। জাতিসংঘ সেখানে যাওয়াতে রোহিঙ্গারা সকল সুবিধা পাবে এমন ধারণা ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের মধ্যে শুরু হয়েছে।

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প ১ এর মাঝি করিম মুস্তফা বলেন, ভাসানচরে জাতিসংঘ যুক্ত হওয়ায় আমরা খুশি। তবে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা ভয় ছিল বন্যা ও জলোচ্ছ্বাস নিয়ে। কিন্তু যারা গেছে তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে বন্যায় তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে বাজার সদাই, ওষুধ পানির সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল। এখন সেই আপত্তি থাকবে না। এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আমাদের যেখানে নেবে সেখানেই যাবো। কিন্তু আমরা মিয়ানমারে যেতে চাই। আমাদের সেই ব্যবস্থাটা করতে পারলে ভালো হতো।

আবার অনেক রোহিঙ্গা ভাসানচরে নিরাপদ মনে করে। সেখানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম কম হবে বলেও মনে করেন তারা। রোহিঙ্গা মানবাধিকার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী আউয়াল বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ যেখানে রাখবে, রোহিঙ্গারা সেখানেই থাকবে। সাধারণ রোহিঙ্গারা নিরাপদে থাকতে চায়। কারণ ক্যাম্পকে ঘিরে একটি চক্র বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে চায়। যা সাধারণ রোহিঙ্গাদের পছন্দ না।

সরকারি কর্মকর্তারাও বলছেন, কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অধিবাসীরাও ইতিবাচকভাবে নিয়েছে ভাসানচরের বিষয়টি। এতদিন যাদের বুঝিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছিল এখন তারা স্বাভাবিকভাবে সেখানে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা যেভাবে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে কাজ করত, একই ভাবে কাজ করবে ভাসানচরেও। আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন মানবিক বিষয়গুলো নিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে আসছে। ভাসানচর নিয়ে শুরুর দিকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল জাতিসংঘ। চুক্তি সইয়ের পর সবকিছু বদলে গেছে।

দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন জানিয়েছেন ভাসানচরের বর্তমান ১৮ হাজার অধিবাসীর সঙ্গে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যুক্ত হবে আরো ৮০ হাজার রোহিঙ্গা।

ঈররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, আরো ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ভাসানচরে যাবে। এতে তিন-চার মাস লাগবে। যারা স্বেচ্ছায় যেতে চায় শুধু তাদেরকেই নিয়ে যাওয়া হবে। রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর ক্যাম্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আরো সজাগ দৃষ্টি রাখা দরকার বলে মনে করেন পররাষ্ট্র সচিব। একইসঙ্গে দ্রুত প্রত্যাবাসন শুরু না হলে ভবিষ্যতে আরো জটিল পরিস্থিতি দেখা দেবে বলেও জানান তিনি। গত শুক্রবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করে মহিবুল্লাহর পরিবারসহ নানা জনের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা বলেন। ক্যাম্পের ভেতর উত্তেজনা বিরাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, যারা অপরাধী তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে।

ভাসানচরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পৃক্তকরণের বিষয়ে সরকার ও জাতিসংঘের মধ্যে গত শনিবার  চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এ লক্ষ্যে সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সমঝোতা স্মারক সই করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই-কমিশন (ইউএনএইচসিআর)। এই চুক্তির আলোকে জাতিসংঘ ভাসানচরে কাজ করবে।

তবে শুরু থেকেই জাতিসংঘসহ আর্ন্তজাতিক নানা সংস্থা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছিল বাংলাদেশকে। এর আগে গত বছর ডিসেম্বরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংস্থাও রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেওয়ার বিরোধিতা করে বিবৃতি দেয়।

এমন পটভূমিতে গত শনিবার ভাসানচরের কার্যক্রমে জাতিসংঘকে যুক্ত করতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, অনেক দিন দ্বিধাদ্বন্ধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে জাতিসংঘ।

ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মহসিন বলেছেন, সবার মূল উদ্দেশ্য হলো মিয়ানমারের নাগরিকদের তাদের দেশে ফেরত পাঠানো। কিন্তু এখানে যতদিন আছে ততদিন কিভাবে তাদের ব্যবস্থাপনা হবে সেটিই উঠে এসেছে সমঝোতা স্মারকে।

 জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের খাদ্য, পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, মিয়ানমার কারিকুলাম ও ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও জীবিকায়নের ব্যবস্থা-এ কাজগুলোই জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক সংস্থার সহায়তায় আমরা করবো। আমাদের এক লাখ লোকের বসবাসের শেল্টার আমরা করেছি, ঘর আছে। শুধু এই মেনটেন্যান্সটা করা হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত ১৮ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেওয়া হয়েছে। এক লাখ রোহিঙ্গাকে নেওয়ার পরিকল্পনা করে সেখানে নৌবাহিনীর মাধ্যমে ১২০টি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে যাতে প্রায় দেড় হাজার ঘর আর পাঁচতলাবিশিষ্ট শেল্টার হাউস আছে আরো একশ বিশটি। এছাড়া এক লাখ লোকের অন্তত আট মাসের খাদ্য মজুতের ব্যবস্থাও সেখানে করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সরকার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads