আমি ফুটপাতের ব্যবসায়ী। করোনার কারণে দীর্ঘ সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ ছিল। ধার-দেনা করে চলতে হয়েছে। এখন সব কিছু খুললেও আগের মতো বেচা-বিক্রি নেই। ফলে আয়ও নেই। কিন্তু কমেনি ব্যয়। যা আয় হয় তা দিয়ে বাসা ভাড়া পরিশোধ করতেই হিমশিম খাই। সংসার চলে কোনোমতে। রাজধানীর আজিমপুরে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে এভাবেই আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বললেন ষাটোর্ধ্ব মনির হোসেন।
তিনি বলেন, ছেলে-মেয়ে নিয়ে পাঁচজনের সংসার আমার। এই সংসারে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা খরচ। কিন্তু সে অনুযায়ী আয় খুবই সামান্য। তার ওপর নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম। সব মিলিয়ে পরিবার নিয়ে টিকে থাকাই এখন দায়।
ফয়জুল আল আমিন নামে আরেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেন, করোনা মহামারি এসে ব্যবসা-বাণিজ্য সব নষ্ট করে দিয়েছে। পরিস্থিতি স্বভাবিক হয়ে আসায় ভেবেছিলাম কোনোরকম খেয়ে-পরে বাঁচতে পারব। এখন পড়া তো দূরের কথা খাবারই জোটে না ঠিকমতো।
তিনি বলেন, নিউ মার্কেটে আমার ছোট্ট একটা কাপড়ের দোকান আছে। গত দেড় বছরে বলতে গেলে দোকানপাট বন্ধই ছিল। এখন খুললেও ক্রেতা নেই। আগে যেখানে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা কমপক্ষে বেচা-কেনা হতো সেখানে এখন ৪/৫ হাজার টাকাও হয় না। ফলে দোকান ও বাসা ভাড়া দিতে পুঁজি ভাঙতে হচ্ছে। আর সংসারের খরচের কথা কি আর বলব। বাজারে গেলেই মাথা গরম হয়ে যায়। আমার ছোট্ট সংসার। তাতেই টান লেগে থাকে। যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তাতে ডাল-ভাত খেয়ে থাকই মুশকিল হয়ে পড়েছে।
শুধু মনির ও ফয়জুল নয়, আয় না থাকায় নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এখন টিকে থাকা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় দিন যাপন করছে। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে চরম ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা। করোনার সময় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আয়ের পথ পুরোপুরি বলতে গেলে বন্ধই ছিল। আর চাকরিজীবীরা ছিলেন হতাশায়। কারণ, ওই সময় কারো চাকরি থাকলে ঠিক ছিল না বেতন। কারো বেতন কমানো হলেও নিয়মিত ছিল না। অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যয় কমাতে কর্মী ছাঁটাই করেছে। ফলে বেড়েছে বেকারত্ব।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন রাসেল। লকডাউন শুরু হওয়ার কিছুদিন চাকরিটা চলে যায় তার। এমন পরিস্থিতিতে পরিবার নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন তিনি। কিন্তু এখন সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে এলেও তার পরিস্থিতি বদলায়নি। রাসেল জানান, প্রতিদিনই একটা চাকরির জন্য এখানে সেখানে ছুটছি। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠানই এখন কর্মী নিচ্ছে না। তাই সংসার চালাতে অল্প বেতনে কয়েকটা টিউশনি করছি। তাতে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছি।
করোনার কারণে গত বছরের মার্চ থেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে। গত সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও পুরো গতি পাওয়ার আগেই হানা দেয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এতে গত ৫ এপ্রিল থেকে চলছে লকডাউন, যা পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম ক্ষতি হয়। এমন পরিস্থিতিতে আগস্টে লকডাউন তুলে নেওয়া হয়।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও নিত্যপণ্যের দাম রীতিমতো অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব কারণে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে বড় ধরনের ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। আর্থিক চাপ সামাল দিতে অনেকের আগের সঞ্চয়ে হাত পড়েছে। সঞ্চয় শেষ করে অনেকে ধার-দেনায় পড়েছেন।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। এই সময়ে মানুষের আয় কমছে। এ অবস্থায় আয়-ব্যয়ে একটি অসামঞ্জস্যতা তৈরি হয়েছে। এতে বেশি বিপাকে পড়ছে স্বল্প আয়ের মানুষ।
তিনি আরো বলেন, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা খুব খারাপ। এই সংকট কাটিয়ে উঠার সহজ কোনো উপায় নেই। সংকট মোকাবিলায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো এবং সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।
লকডাউনের পর দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪০ শতাংশ, মধ্যবিত্তের হার কমে ৫০ শতাংশ এবং ধনীর হার আগের মতো ১০ শতাংশ রয়েছে। অর্থাৎ, করোনার থাবার মধ্যেও ধনীর হার ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের ২০ শতাংশের আয় কমে তারা দরিদ্রের মধ্যে চলে গেছে। ফলে মধ্যবিত্তের হার ২০ শতাংশ কমেছে। দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে।
পিপিআরসি ও বিআইজিডির জরিপে বলা হয়, করোনার ফলে কাজ হারিয়ে কিছু মানুষ কাজে ফিরতে পারলেও এখনো ৮ শতাংশ মানুষ কোনো কাজ পাচ্ছে না। ফলে তারা বেকার জীবনযাপন করছে। শহরের বস্তিবাসী করোনাভাইরাসের আগে যে আয় করতেন, এখন তারা সে পরিমাণে আয় করতে পারছেন না।