• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
ধর্মঘট রোধে হচ্ছে আইন

ছবি : বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

ধর্মঘট রোধে হচ্ছে আইন

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৭ নভেম্বর ২০২১

ধর্মঘটের নামে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি রোধে কঠোর হচ্ছে সরকার। জেল-জরিমানার বিধান রেখে পরিবহন ধর্মঘট রোধে আইন করা হচ্ছে। এই আইন বাস্তবায়ন হলে পরিবহন মালিকরা চাইলেই ধর্মঘটের ডাক দিতে পারবেন না। সাধারণ মানুষকেও দুর্ভোগ পোহাতে হবে না।

এদিকে চলমান ধর্মঘটে ভেঙে পড়েছে দেশের পরিবহন ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পরিবহন মালিকদের বৈঠকেও হয়নি কোনো সিদ্ধান্ত। আভাস মিলছে ভাড়া বৃদ্ধির। তবে এর মাশুল গুনতে হবে সাধারণ মানুষকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে উভয় পক্ষ। ভাড়া বৃদ্ধি না করলে লঞ্চ না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মালিকরা।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে গত শুক্রবার থেকে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটে নামে বাস-ট্রাক মালিকরা। তাদের এই ধর্মঘটে গতকাল শনিবার থেকে যোগ দেন লঞ্চ মালিকরাও। আজ রোববার সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে মালিকদের গাড়ি চালানোর বিষয়টি।

এদিকে ধর্মঘট রোধে ‘অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন, ২০২১’ নামে এ আইনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এটি এখন ভেটিং বা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে আছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা। 

নতুন এই আইনে জরুরি প্রয়োজনে বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ, পরিবহনসহ যেকোনো সেবাকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা’ ঘোষণা করতে পারবে সরকার। ‘অত্যাবশ্যক’ ঘোষণার পর সেখানে ধর্মঘট ডাকা যাবে না, মালিকরাও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারবেন না। তা না মানলে এক লাখ টাকা জরিমানা ও এক বছর কারাদন্ডের বিধান রাখা হচ্ছে।

জানা গেছে, গত ৪ অক্টোবর সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার ওই বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছিলেন, সরকার যে কোনো সময় জরুরি প্রয়োজনে বিভিন্ন সেবাকে অত্যাবশ্যক পরিষেবা ঘোষণা করতে পারবে। অত্যাবশ্যক ঘোষণার পর কর্মীরা বেআইনিভাবে ধর্মঘট ডাকতে পারবেন না, মালিকরা কারখানা বন্ধও করতে পারবেন না, লে-অফও করতে পারবেন না। কোন কোন সেবা এর আওতায় থাকবে তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল, ডিজিটাল আর্থিক সেবাসহ যেকোনো ডিজিটাল সেবা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ, জল, স্থল ও আকাশপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন, বিমানবন্দর পরিচালনা, স্থল ও নদীবন্দর পরিচালনা, কাস্টমসের মাধ্যমে কোনো পণ্য ও যাত্রীর পণ্য ছাড় করার কাজ, সশস্ত্র বাহিনীর কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো কার্যক্রম, প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যক্রম, খাদ্যদ্রব্য ক্রয়, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত কার্যক্রম ইত্যাদি। সরকার এগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা করতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, আইন ভাঙলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদন্ড হতে পারে। মালিক ভাঙলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও এক বছর পর্যন্ত কারাদন্ড হবে। কেউ আইন ভাঙতে প্ররোচিত করলে এক বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।

পরিবহনের মতো জনসম্পৃক্ত সেবাসমূহের সংশ্লিষ্টদের দাবি আদায়ের নামে ধর্মঘটের ফলে জনসাধারণের চরম ভোগান্তিতে পড়েন। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গত শুক্রবার থেকে চলছে পরিবহন মালিকদের অঘোষিত ধর্মঘটে। সমস্যা সমাধানে গতকাল দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের সঙ্গে তার ধানমন্ডির সরকারি বাসভবনে বৈঠকে বসেন বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান ট্রাক পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকের পরও ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয় কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। দাবি মানা না হলে ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে বলে স্পষ্ট জানিয়েছেন তারা। সংগঠনের অতিরিক্ত মহাসচিব আবদুল মোতালেব জানান, তেলের দাম প্রত্যাহারের দাবিতে দেওয়া ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে তাদের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে  আবদুল মোতালেব আরো বলেন, যেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়নি, তাই আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। যেকোনো সময় মন্ত্রী আমাদের ডাকতে পারেন, আমাদের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কী সিদ্ধান্ত দেন সেটি জানানোর জন্য।

ধর্মঘটের প্রথমদিন ছুটির দিন হওয়ায় খুব একটা প্রভাব পড়েনি জনজীবনে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের পরীক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল। তবে গতকাল শনিবার তাদের ভোগান্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও জরুরি সেবা সংস্থার কর্মীরাও। সকাল থেকেই তাদের সড়কের মোড়ে মোড়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। বাস বন্ধ থাকলেও চালু রয়েছে সরকারি পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির বাস। যাতে করোনার এই সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মানাতো দূরে থাক কোনোরকম জায়গা পাওয়াই যেন হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর কোনো একটি বাস এলেই হুড়োহুড়ি করে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ওঠা শুরু করেন অপেক্ষারতরা। প্রতিটি বাসেই দেখা গেছে ভিড়।  

আবার বাস চলাচল বন্ধের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কগুলোতে বেড়েছে রিকশা, সিএনজি ও মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য। দ্বিতীয় দিনের ধর্মঘটে সড়কে বের হওয়াদের ভোগান্তি ছিল চরমে। একটি সিএনজি দেখলে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন যাত্রীরা। এ সুযোগে বেশি ভাড়া চাইছেন সিএনজিচালকরাও। একই অবস্থা ভাড়ায় চালিত মোটরবাইকগুলোরও। আবার বাধ্য হয়ে অনেকেই হেঁটেই রওনা দিচ্ছেন গন্তব্যে। সাধারণ যাত্রীরা বলছেন, সরকার জনগণকে এভাবে ভোগান্তিতে না ফেলে অতি দ্রুত এ ব্যাপারে যেন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়।

সাইফুল ইসলাম নামে মিরপুরে এক ব্যবসায়ী বললেন, বাস চলাচল বন্ধ আছে। এ সময় এই যে সিএনজি এবং রিকশার অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে, এগুলো নজরদারির জন্যতো কাউকে দেখছি না। কল্যাণপুর থেকে প্রতিদিনই আমাকে কাজের জন্য মিরপুরের দিকে যেতে হয়। রিকশায় যেখানে প্রতিদিন ৪০ টাকা করে যেতাম, গত দুদিন ধরে বাস বন্ধ থাকায় সেখানে আমাকে যেতে হচ্ছে ৮০ টাকা করে।

মোহাম্মদপুরের একটি সরকারি কলেজের শিক্ষক রেজাউর রহমান। সকালে জরুরি কাজে কলেজের উদ্দেশে বের হয়েছেন তিনি। এই শিক্ষকের ভাষ্য, রাস্তায় যা চলছে তা রীতিমতো এক ধরনের ডাকাতি। গন্তব্যে যেতে রিকশা, সিএনজি কিংবা মোটরসাইকেলে ভাড়া চাইছে দ্বিগুণেরও বেশি।

এদিকে ভেঙে পড়া চলমান ধর্মঘটে সাথে যুক্ত হচ্ছে নৌপথও। গতকাল শনিবার বিকালের দিকে রাজধানীর সদরঘাট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় দূরপাল্লার সব ধরনের লঞ্চ। আনুষ্ঠানিক ধর্মঘটের ঘোষণা না দিলেও জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআইডব্লিউটিএ) নৌযানের ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল লঞ্চ মালিক সমিতি। গতকাল শনিবার দুপুরের মধ্যে ভাড়া সমন্বয় না করলে বিকাল থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করার হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছিলেন মালিকরা। কিন্তু দুপুরের মধ্যে কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় অঘোষিত ধর্মঘটে যান লঞ্চ মালিকরা।

লঞ্চ মালিকদের সংগঠন অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাপ) সংস্থার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদ (বীর বিক্রম) জানান, সাংগঠনিকভাবে আমরা এখনো ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিইনি। তবে লঞ্চ মালিকরা লঞ্চ চালাবে না বলে জানিয়েছেন। তাই তারা তাদের লঞ্চ সরিয়ে নিচ্ছেন।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর সূত্রে জানা যায়, আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে পরিবহন ধর্মঘটের বিষয় নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেই বৈঠকে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হবে। এরপর বিকেল ৩টার দিকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। সেখানেই হয়তো ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হতে পারে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনয়েত উল্লাহ বলেছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো প্রস্তাব সেভাবে আসেনি। এ বিষয়ে আমরা পরিবহন মালিক শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন রোববার বেলা ১১টার দিকে আলোচনায় বসব। সেখানে আমরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাব। এই মিটিং চলা পর্যন্ত আমাদের ধর্মঘট চলবে। বাস ভাড়া বৃদ্ধির আভাস দিয়ে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমবে-এমন কোনো আভাস আমরা এখনো পাইনি। বৈঠকে পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।

তবে যাত্রীরা বলছেন, যদি তেলের দাম না কমে এবং গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানো হয়, তবে সাধারণ মানুষের ওপরই এর প্রভাব বেশি পড়বে। তারা বলছেন, সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। যদি ভাড়া বেড়ে যায়, তবে চলাচলে নাজেহাল হবেন যাত্রীরা। প্রতিদিনই ভাড়া নিয়ে ঝামেলার সৃষ্টি হবে পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে। পরিবহন মালিক সমিতির একাধিক নেতারা বলছেন, সরকার যদি জ্বালানি তেলের দাম না কমায় তবে পরিবহনের ভাড়া বাড়ানো ছাড়া আর কোনো গতি থাকছে না। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে সব সংগঠনে আলোচনা চলছে। পরিবহন শ্রমিকরাও বলছেন, ভাড়া বাড়ানো হলে যাত্রীদের সঙ্গে ঝামেলার সৃষ্টি হবে। কারণ অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে সবারই কষ্ট হবে। এতে করে প্রতিদিন যাত্রীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হবে। 

এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিও প্রতিবাদে পরিবহন মালিকরা ধর্মঘট ডাকলেও বাস বন্ধ রেখে যাত্রী ভোগান্তি সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে গ্যাসচালিত বাস মালিকদের বিরুদ্ধে। যাত্রীদের অভিযোগ এই ধর্মঘট আসলে তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদ না, এটা ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা।

ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, রাজধানীর অধিকাংশ গণপরিবহনই সিএনসিচালিত। তারপরেও তারা কেন বাস বন্ধ রেখেছেন? সিএনজিচালিত অটোরিকশায় কেন দ্বিগুণ-তিনগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে? সংশ্লিষ্টদের যথাযথ মনিটরিং না থাকায় ধর্মঘটের নামে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে গণপরিবহনে ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা চলছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads