• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

সিদ্ধান্ত নিলেও নেই বাস্তবায়ন

১৪০টি শুল্ক স্টেশন বিলুপ্ত করার উদ্যোগ

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর ২০২১

ইংরেজ আমলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে চাঁদপুর ও ফরিদপুরের গোয়ালন্দ ছিল বেশ জমজমাট। তখন কলকাতা থেকে রেলপথে ও নৌপথে বড় বড় নৌকায় করে পণ্যের চালান আসত। এ কারণে ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এ দুটি স্থানে বড় দুটি শুল্ক স্টেশন করা হয়। কিন্তু ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর দুটি শুল্ক স্টেশনই বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে কলকাতা থেকে খুলনা পর্যন্ত স্টিমার রুট থাকায় খুলনা স্টিমারঘাটে শুল্ক স্টেশন করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ওই রুট বন্ধ হয়ে গেলেও শুল্ক স্টেশনটি এখনো বিলুপ্ত করা হয়নি।

এভাবে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মোট ১৮৪টি শুল্ক স্টেশনের মধ্যে বর্তমানে কার্যক্রম চলমান রয়েছে মাত্র ৩৭টির। বাকিগুলো কাগজে কলমে অস্তিত্ব থাকলেও নেই কোনো কার্যক্রম। কিন্তু বিভিন্ন সময় এসব অকেজো শুল্ক স্টেশন বিলুপ্তির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

সবশেষে গত ১৩ অক্টোবর এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় অকেজো স্টেশনগুলোর মধ্য থেকে ৭টি নতুন করে সচল করার পাশাপাশি বাকি ১৩৩ স্টেশনকে বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর আগে প্রাথমিকভাবে ১৪০টি শুল্ক স্টেশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলো। তবে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিসহ সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে প্রেমতলী (গোদাবাড়ি), আরিচাঘাট, মুজিবনগর (বৈদ্যনাথ তলা), রায়মঙ্গল/আংটিহারা, ধামর হাট, আমনুরা রেল স্টেশন ও রাজশাহী বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তাই ৭টি ছাড়া অন্যান্য সব অনুমোদিত এলসি স্টেশন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

অকার্যকর শুল্ক স্টেশনগুলো বিলুপ্ত করতে দেড় দশক ধরে কয়েকবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও রাজনৈতিক কারণে তা সম্ভব হয়নি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।  কারণ, শুল্ক স্টেশন বন্ধ করতে এনবিআরের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মতামতের প্রয়োজন। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় জনপ্রতিনিধিরা শুল্ক স্টেশনগুলো বিলুপ্ত হোক তা চান না বলে জানান, এনবিআর কর্মকর্তারা।

জানা গেছে, এর আগে ২০০৭ সালের ১ জুলাই ৫০টি শুল্ক স্টেশন অকার্যকর ঘোষণা করা হয়। ২০১২ সালেও আবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এনবিআরের গঠিত কমিটি একটি এ বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত কোন অগ্রগতি হয়নি। এরপর ২০১৮ সালে আবারো উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন বাণিজ্য, নৌ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক একাধিক সভা করে কোন কোন শুল্ক স্টেশন বিলুপ্ত করা হবে, এর একটি খসড়া তালিকাও করেছিল এনবিআর। সেবারও বাস্তবায়ন হয়নি এনবিআরের সেই উদ্যোগ সফল হয়নি।

তাই চতুর্থবারের মতো এনবিআরের নেওয়া এই উদ্যোগ সফলতার মুখ দেখবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এবার ১৩৩ স্টেশন বিলুপ্ত করার বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। যদিও চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপনের আগে এমন সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলা যাচ্ছে না। আমদানি-রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ও প্রতিনিধির সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের স্থল সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় দুই হাজার ৪০০ কিমি। যার শতকরা ৯২ ভাগ ভারত এবং বাকি ৮ ভাগ মিয়ানমারের সঙ্গে। দেশের ছোট-বড় ঘোষিত ১৮৪ শুল্ক স্টেশনের অধিকাংশই দুই দেশের সীমান্তবর্তী। এ শুল্ক স্টেশনগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত ও নির্বাচিত স্টেশনে স্থলবন্দর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ (বাস্থবক)। বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমদানি-রফতানির শুল্ক কিংবা চোরাচালান প্রতিরোধে গুরু দায়িত্ব পালনে শুল্কে স্টেশনের জন্ম। যা দায়িত্ব থাকে এনবিআরের কাস্টম বিভাগ। দেশের সক্রিয় ৩৭ শুল্ক স্টেশনের মধ্যে ২৪টি রয়েছে স্থলবন্দরে। যেখান থেকে নিয়মিত ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে। যার মধ্যে রয়েছে-বেনাপোল, তামাবিল, হিলি, সোনামসজিদ, দর্শনা, শেওলা, বুড়িমারী, ছাতক, বিরল, বিবিরবাজার, টেকনাফ, আখাউড়া, জকিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারতের ট্রানজিট ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে আমদানি-রপ্তানি সচল করতে সিলেটের তামাবিল, কুড়িগ্রামের চিলমাড়ি ও শেরপুরের নাকুগাঁওকে আনুষ্ঠানিকাভাবে সচল করা হয়। বাকি শুল্ক স্টেশনগুলো দিয়ে কোনো রকম আমদানি-রপ্তানি হয় না। এগুলো কাগজে-কলমেই শুধু শুল্ক স্টেশন।

যদিও গত অক্টোবরের অপর এক বৈঠকে ঘোষিত পাঁচটি এলসি স্টেশনকে প্রজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও এনবিআর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে মাতারবাড়ি, রামপাল, বিএম এনার্জি এলপিজি টার্মিনাল, জেএমআই এলপিজি টার্মিনাল, ইউনিটেঙ্ এলপিজি টার্মিনাল ও প্রিমিয়ার এলপিজি টার্মিনাল। সবকিছু মিলিয়ে এনবিআর অর্ধশতাধিক শুল্ক স্টেশন সচল রাখার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।

২০০৭ সালের জুলাই মাসে যে ৫০টি শুল্ক স্টেশন অকার্যকর ঘোষণা করে স্থায়ীভাবে বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো-ডোরা বাজার, পাকশী, বরিশাল, চরমুগুরিয়া, গোয়ালন্দ, শংকর, শিবগঞ্জ, নীদপুর, প্রেমতলী, ধামইরহাট, বগুড়া, সান্তাহার, নেকমর্দ, নীলফামারী, মোগলহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, উখিয়া ঘাট, চৌমুহনী, শুভপুর, কুমারঘাট, লাতু, কুমিল্লা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, সরিষাবাড়ী, ভৈরব, ময়মনসিংহ, মীরকাদিম, মুন্সিগঞ্জ, লৌহজং, আরিচাঘাট, রংপুর, আনমুরা রেলস্টেশন ও শ্রীপুর।

এনবিআরের কাস্টম বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমাদের লক্ষ্য হয় দীর্ঘদিন আগের ঘোষণাকরা শুল্ক স্টেশনগুলো চালু হোক, না হলে স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হোক। যেখান দিয়ে আমদানি বা রপ্তানির কোনো সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই, তা কাগজে-কলমে রাখার কি দরকার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads