• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

সড়ক নিরাপত্তা আইন

প্রয়োগ নেই তবুও সংশোধনের উদ্যোগ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৭ নভেম্বর ২০২১

সড়ক নিরাপত্তা আইন থাকলেও প্রয়োগ না থাকায় বেপরোয়া বাসচালকরা। আর এ কারণে বার বার দুর্ঘটনার পর রাস্তায় নেমে আসতে হচ্ছে শিক্ষাির্থীদের। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে আইন পাস করে সরকার। কিন্তু পরবর্তীতে মালিক-শ্রমিকদের চাপের মুখে তা থেকে নমনীয় হয়। ওই আইন প্রয়োগ না হলেও মূলত এখন ওই আইনের সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে বেপরোয়া পরিবহন সেক্টরের লাগাম ছেড়ে দেওয়ার শামিল মনে করছেন অনেকে।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের সংঘর্ষে রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া নিহত হয় এবং ১০ জন শিক্ষার্থী আহত হয়।

ঘটনার পর ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সংঘটিত হয়। যা গণবিক্ষোভে রূপ নেয়। দেশের ইতিহাসে এটি অরাজনৈতিক স্বতঃস্ফূর্ত একটি আন্দোলন ছিল।

শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে সড়ক নিরাপত্তা আইন করলেও সে আইনের চারটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা (৭৪, ৮৪, ৯৮ ও ১০৫) নিয়ে প্রথমে আপত্তি তোলে বাস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। সারাদেশে পরিবহন ধর্মঘট পালন করে তারা। পরবর্তীতে এই ধারাগুলো প্রয়োগ স্থগিত রাখে সরকার। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব ধারায় পুলিশ কোনো মামলা করেনি। যদিও এই সিদ্ধান্তকে বিতর্কিত বলছেন দেশের আইনজ্ঞরা। কারণ সংসদে পাস হওয়া কোনও আইন আংশিক প্রয়োগের বৈধতা নিয়ে তারা প্রশ্ন তোলেন।

সরকারের এই সিদ্ধান্তেও মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো খুশি থাকেনি। তারা আইনটির আরও পাঁচটি ধারায় আপত্তি জানায়। মোট ৯টি ধারা তারা বাদ দিতে সরকারকে চাপ দিতে থাকে।

এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বরে মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের আপত্তির ৯টি ধারায় আইনের প্রয়োগ শিথিল রাখার সিদ্ধান্ত জানান।

শ্রমিক ও পরিবহন মালিকদের চাপের মুখে, এ বছর আইনটির সংশোধনীর জন্য প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। গত মে মাসে সংশোধিত আইনের খসড়া প্রণয়ন করে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

সংশোধনীতে ১২৬টি ধারার মধ্যে ২৯টি ধারায় সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে মালিক ও শ্রমিকরা ৩৪টি ধারায় সংশোধন ও পরিবর্তন চায়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী জানিয়েছেন, তারা অন্তত ৩৪টি ধারার সংশোধন চেয়েছিলেন।

সংশোধনী প্রস্তাবে মূলত সাজা ও জরিমানা হ্রাস, মামলা করার সুযোগ হ্রাস ও দুর্ঘটনার দায় থেকে তুলনামূলকভাবে চালকদের মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

এছাড়াও প্রস্তাবিত সংশোধনীতে জামিন অযোগ্য প্রতিটি ধারাকে জামিনযোগ্য করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের একাধিক আইনজীবী।

তারা বলছেন, ‘আইনটির ১০৫ ধারা অনুযায়ী মোটরযান দুর্ঘটনায় মৃত্যু কিংবা কেউ মারাত্মকভাবে আহত হলে যদি এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে গাড়ি চালানোর অপরাধ প্রমাণিত হয় তাহলে জড়িতদের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড কিংবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। তবে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কারাদণ্ডের পরিমাণ একই রেখে জরিমানার পরিমাণ তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। ’

সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী বলছেন, ১০৫ ধারাটির থেকে ‘মারাত্মকভাবে আহত’ কথাটি বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কোনো দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যু না হলে বহু মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হলেও সে ঘটনায় জড়িতদের এই ধারার অধীনে শাস্তির আওতায় আনা যাবে না; যতই নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন চালাক না কেন।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এই আইন কখনও বাস্তবায়ন হবে না, সেজন্যই করা হয়েছিল। ছাত্রদের চাপের মুখে একটা আইন করার দরকার ছিল তাই করেছে। এখন আবার সেটা সংশোধন করা হবে। এ আইন দিয়ে আসলে সমস্যার সমাধান হবে না।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের অবকাঠামো পরিবর্তন করতে হবে। ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে যারা পরিবহন সেক্টরের মাফিয়া হয়ে আছে সেই সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। তাহলে কিছুটা সমাধান হতে পারে। কারণ তাদের হাতে পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকরাও জিম্মি। তারা শ্রমিকদের ব্যবহার করে।’

এদিকে তিন বছরের মাথায় আবারও জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আবারো রাজপথে শিক্ষার্থীরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের এর আগের আন্দোলনের কারণে একটি নতুন আইন পেলেও তার সম্পূর্ণ প্রয়োগ হয়নি কখনো। বাস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবির মুখে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৯টি ধারার কখনো প্রয়োগ হয়নি। উল্টো তাদের চাপের মুখে আইনটি সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইনটি সংশোধনে সংসদে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।

নতুন আইন করার পরও কেন সড়কে শৃঙ্খলা আনা যাচ্ছে না—এমন প্রশ্নের জবাবে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘একটা আইন হলো কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হলো না। আবার সেটা কাটছাঁট করা হলো। সংশোধনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এটিকে সংসদে সংশোধনের জন্য পাঠানো হবে। মূলত পরিবহন সেক্টরের চাপে পরে সরকার এই কাজটি করছে। কিন্তু যারা পরিবহন সেক্টরের নেতৃত্বে রয়েছে তারা সরকারেও রয়েছে। তাহলে বাধা কোথায়? বাধাটা আসলে ইচ্ছাকৃত। এরা চায় না সড়কের শৃঙ্খলা, তাই বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। শ্রমিকদের ব্যবহার করে তারা তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা গত আন্দোলনের সময় বলেছিলাম, যদি দাবি আদায় না হয় তাহলে ফের পথে নামবো। ছাত্ররা তাই আবার রাস্তায় নেমেছে।’

একই প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলছেন, ‘পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবির মুখে আইনটির বেশ কিছু ধারা কখনোই প্রয়োগ হয়নি। এমনকি সেগুলো পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই এই আইন চালক ও মালিকদের মধ্যে প্রথমে যে ভীতি ছড়িয়েছিল, তা পরে আর কাজ করেনি। কারণ শ্রমিকরা আন্দোলন করে ৯টি ধারায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত আদায় করে নেয়। অর্থাৎ আমাদের কঠোর আইন আছে, কিন্তু তা মানার ক্ষেত্রে নমনীয়তা রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশে আইন নমনীয় হলেও সেটির প্রয়োগ হয় কঠোর হাতে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads