• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ইইএফ ঋণের অর্থ লোপাটের অভিযোগ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১১ ডিসেম্বর ২০২১

ইক্যুইটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ফান্ডের (ইইএফ) আওতায় দেওয়া বিপুল অঙ্কের ঋণের অর্থ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই দেওয়া হয়েছে টাকা। ঋণ বণ্টনের ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ।

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিএজি) সরকারি হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি ইইএফ তহবিল থেকে ঋণ নেওয়া ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক তথ্য বিশ্লেষণের পর এসব অনিয়মের চিত্র উঠে আসে।

কৃষিভিত্তিক, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে গঠন করা হয়েছিল ইইএফ। দেওয়া হয়েছিল ৪১৯ কোটি টাকা। কথা ছিল ৮ বছর পর এই অর্থ ফেরত আসবে সরকারি কোষাগারে। কিন্তু ২০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেখা মেলেনি সেই অর্থ।

নতুন উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে ২০০১ সালে ইইএফ গঠন করে সরকার। উদ্দেশ্য ছিল, এসব খাতে উদ্যোক্তাদের ঋণের পরিবর্তে মূলধন দেওয়া হবে। প্রকল্পে সরকারের মালিকানা দেওয়া হয় ৪৯ শতাংশ। বাকি ৫১ শতাংশ মালিকানা উদ্যোক্তাদের। তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে বিনিয়োগ করে তা আট বছর পর সরকারের কোষাগারে ফেরত দেওয়ার কথা। কিন্তু ২০ বছর পার হলেও অনেক উদ্যোক্তাই টাকা ফেরত দেয়নি। এতে সরকারের গচ্চা গেছে ৪১৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা।

মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিএজি) সরকারি হিসাবসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির ৫৩তম বৈঠকের কার্যপত্রে এমন চিত্র উঠে আসে। সম্প্রতি ২৫ প্রকল্পের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর শুনানিও হয়েছে। শুনানিতে টাকা উদ্ধারে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছে কমিটি। একই সঙ্গে মামলার অগ্রগতি সিএজির মাধ্যমে কমিটিকে জানাতে বলা হয়েছে।

বৈঠকের কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, উদ্যোক্তাদের অনেককেই এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার অনেকে ইচ্ছে করেই যোগাযোগ করছেন না। প্রকল্পের আয়-ব্যয়ের তথ্যও দিচ্ছেন না তারা। বার বার নোটিশ দিলেও সাড়া দিচ্ছেন না প্রকল্পের উদ্যোক্তারা।

প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ বাস্তবায়ন না করেই গ্রাহকের অনুকূলে অর্থ ছাড় করা হয়েছে। কোম্পানির নামে জমি রেজিস্ট্রেশন ও শেয়ার রিটেন অব অ্যালটমেন্ট বাদ রেখে এবং ভিত্তিহীন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অর্থ দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়া প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই না করা, আমদানিকৃত যন্ত্রপাতির প্রকৃত দাম ও মান নিরুপণ না করা, বিনিয়োগকৃত জমির মান যাচাই না করে ভুয়া ডকুমেন্টের বিপরীতে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এই ফান্ডের টাকা নিয়ে অন্য প্রকল্পে ব্যবহারের প্রমাণও মিলেছে।

প্রকল্পের নামে ব্যাংকে ঋণ থাকা সত্ত্বেও আবার অর্থ দেওয়া হয়েছে। ইইএফ নীতিমালা উপেক্ষা করে দ্রুত ঋণ ছাড় করাসহ নানা অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে কমিটি। রাজনৈতিকসহ নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে সেই অর্থ আর ফেরত দেননি অনেকেই।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ইইএফ থেকে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে প্রায় অর্ধেক বিনিয়োগকারী। ইইএফ থেকে মূলধন সহায়তা গ্রহণের পর যেসব প্রতিষ্ঠান উধাও হয়ে গেছে, তাদের অধিকাংশের কোনো অস্তিত্ব নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণ দেওয়া হয়েছিল। তাই অনেকের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা সম্ভবও হয়নি।

তহবিলটি ২০০১ সালে গঠন করে সরকার। ২০০৯ সাল পর্যন্ত নয় বছর এটি পরিচালনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপর ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে ইক্যুইটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ফান্ড (ইইএফ) নাম পরিবর্তন করে এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ সাপোর্ট ফান্ড (ইএসএফ) করা হয়।

২০০১ থেকে ২০১৪ অর্থবছর পর্যন্ত ইইএফ সহায়তা খাতে সরকারের তহবিল থেকে ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা তোলা হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, কৃষিভিত্তিক ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ১ হাজার ১৫৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। এ সময়ে শেয়ার বাইব্যাক বাবদ আদায় হয় মাত্র ১৭৩ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর ৬৭০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঞ্জুরিপত্রের শর্তানুযায়ী যথাযথভাবে টাকার ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়নি। ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যে ঠিকানা দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো তহবিল থেকে অর্থ সহায়তা নিয়েছে, সেখানে তারা নেই। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক দেশ ছেড়েও চলে গেছেন। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া সরকারের ৪১৯ কোটি টাকা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, অর্থ ছাড়ের আট বছরের মধ্যে পুনরায় শেয়ার ক্রয় বা বাই ব্যাকের মাধ্যমে সহায়তার অর্থ সরকারের তহবিলে ফিরে আসার কথা। তবে এসেছে মাত্র ১৭৩ কোটি টাকা। বাকি টাকা এখনও সরকারের কোষাগারে ফেরেনি

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, অডিটের আপত্তিগুলো যাচাই করা হচ্ছে। যেসব প্রকল্প নিয়ে তারা আপত্তি করেছে, সেগুলো কোন পর্যায়ে আছে তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন দায়িরত্বরত নির্বাহী পরিচালক নির্মল কুমার ভক্ত বলেন, আমি ২০১৬ সালের দিকে খুব অল্প সময়ের জন্য ওই তহবিলের দায়িত্বে ছিলাম। তখন অনেক যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এর আগের অবস্থা আমি বলতে পারব না।

তহবিল ব্যবস্থাপনাকারী আইসিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনেকেই ইইএফ থেকে টাকা নিয়ে ফেরত না দিলেও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

সিএজির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই না করে ও উৎপাদন বন্ধ থাকার পরও নোয়াখালীর গোল্ড ফিস লিমিটেডকে ইইএফ ফান্ডের ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।

উৎপাদনে না থাকলেও মেসার্স ফ্লেমিঙ্গো এগ্রোটেক লিমিটেডকে দেয়া হয়েছে ৩ কোটি টাকা। পটেটো ফ্ল্যাক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান এক প্রকল্পের নামে অর্থ নিয়ে অন্য প্রকল্পে ব্যয় করেছে। এখানে সরকারের গচ্ছা গেছে ৫ কোটি টাকা।

দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করে সম্পূর্ণ নতুন কোম্পানির পুরোনো মজুতকে গ্রস চলতি মূলধন দেখিয়ে এ তহবিল থেকে ঋণ নেয় কোয়ালিটি এগ্রো ফরেস্ট্রি লিমিটেড। এখানে ১৭ কোটি টাকা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

পটুয়াখালীর বাউফলে আলতাফ ফিসিং লিমিটেডকে দেওয়া হয় ৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রকল্প মূল্যায়নকারী কর্মকর্তার যোগসাজশে জমির দলিল না দিয়েই টাকা উঠিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের এই তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে নির্ধারিত সময় শেষেও ফেরত না দেওয়ার ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads