• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯
হাসপাতালে বাড়ছে করোনা রোগীর চাপ

কার আগে কে টিকা নেবেন, তা নিয়ে চলে হুড়োহুড়ি। স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব মানছেন না কেউই। অনেকের মুখে ছিল না মাস্ক। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল থেকে তোলা ছবি

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

হাসপাতালে বাড়ছে করোনা রোগীর চাপ

অসতর্কতায় বাড়ছে সংক্রমণ

  • রেজাউল করিম হিরা
  • প্রকাশিত ১২ জানুয়ারি ২০২২

গত একদিনে দেশে নতুন করে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে প্রায় আড়াই হাজারের কাছাকাছি। শনাক্তের হার ৯ ছুঁইছুঁই। গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণ ও শনাক্তের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীর চাপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পরেই মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে উদাসীনতা দেখা দিয়েছে। আর এই অসতর্কতায় সংক্রমণ এখন ঊর্ধ্বমুখী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত একদিনে দেশে করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ৪৫৮ জন। শনাক্তের হার ৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ।  এ সময়ে মারা গেছেন দুজন। এ নিয়ে দেশে এখন পর্যন্ত মোট শনাক্ত হলেন ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩৮৯ জন। তাদের মধ্যে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৮ হাজার ১০৭ জনের।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে দেশে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিনই বাড়ছে নতুন রোগী ও শনাক্তের হার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থেকে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত করোনায় শনাক্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৪৬৫ জন। তার আগের সাতদিনে শনাক্ত হয়েছিলেন ৩ হাজার ২১৩ জন। অর্থাৎ গত সপ্তাহে তার আগের সপ্তাহের তুলনায় ১২৫ দশমিক ১ শতাংশ রোগী বেশি শনাক্ত হয়েছেন। আর করোনার অতি সংক্রমণশীল নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনে দেশে শনাক্ত হয়েছেন ৩০ জন। গত ৪ নভেম্বর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ন্ত্রণে আসার পর প্রথমবারের মতো তা ৫ শতাংশ ছাড়ায় গত ৭ জানুয়ারি। এরপর থেকে বেড়েই চলেছে শনাক্তের হার

দেশে করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়লেও সর্বত্র স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি উপেক্ষিত। গণপরিবহনগুলোতেও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গাদাগাদি করে তোলা হচ্ছে যাত্রীদের। নেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার। চালক-হেলপার থেকে শুরু করে যাত্রীদের মধ্যে মাস্ক ব্যবহার নিয়েও রয়েছে অনীহা। আর মাস্ক পরাদের মধ্যে বেশিরভাগই থুতনিতে ঝুলিয়ে রাখছেন।  জানতে চাইলে বলছেন, দীর্ঘ সময় মাস্ক পরে থাকতে সমস্যা হয়। সেজন্য মাঝে মধ্যে খুলে রাখেন।

চালকের সহকারীরা বলছেন, সারাদিন গাড়িতে থাকি। গরমের কারণে সবসময় মাস্ক পরা যায় না। তাছাড়া মাস্ক পরে কথা বলতে সমস্যা হয়।

সরকারের রোগ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলছে, এখনো দেশে ওমিক্রন নয় বরং ডেল্টার প্রভাব চলছে। সেই সঙ্গে রয়েছে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে চরম উদাসীনতা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসতর্কতার কারণেই সংক্রমণ বাড়ছে। স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

আইইডিসিআর-র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, পৃথিবীজুড়ে লাখো মানুষ প্রতিদিন করোনাতে শনাক্ত হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ ভাইরাসটি অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে। আর পরিবর্তিত যে কোনো ভাইরাস আমাদের জন্য যে কোনো সময় বিপজ্জনক হতে পারে। ঘর থেকে বের হলেই মাস্ক পরতে হবে, একে জীবনের অঙ্গ করে নিতে হবে। বয়োজ্যেষ্ঠদের জরুরি কাজ না থাকলে ঘরের বাইরে না যাওয়ার কথাও বলেন তিনি।

গত কয়েক সপ্তাহে হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চাপ বাড়ছে জানিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. কাজী তরিকুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে রোগীদের চাপ বাড়ছে। যাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে-তারাই ভর্তি হতে হাসপাতালে আসছেন।

দেশে সংক্রামকব্যাধি আইন রয়েছে, সেটাও বাস্তবায়ন করা যায় না জানিয়ে অধ্যাপক কাজী তরিকুল ইসলাম বলেন, এমনকী শিক্ষিত বলে আমরা যারা রয়েছি, তারাও মাস্ক পরছি না, হেলথ বা সোশাল এটিকেট মানছি না আর অশিক্ষিত কিংবা খেটে খাওয়া অথবা নিম্নবিত্তশ্রেণির কথা বাদই দেওয়া হলো।

দেশে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবার পরেই মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে উদাসীনতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, টিকা নিতে হবে কারণ হয়তো তাতে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু মাস্ক পরলে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা বলেন, ডেল্টাতে যদি চারজন আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে ওমিক্রনের আক্রান্ত হবে ২০ জন। মনে রাখা দরকার, ওমিক্রনে আক্রান্ত যত বেশি হবে, ততোই সিরিয়াস বা সিভিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে যারা টিকা নেয়নি, ষাটোর্ধ্ব, যারা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত-তারা যদি ওমিক্রনে আক্রান্ত হন তাহলে তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুতর হয়ে যাবে।

তিনি আরো বলেন, হাসপাতালে অনেক রোগীকেই পাওয়া যাচ্ছে যারা ভেতরে ভেতরে অনেক খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বর্তমানে সাধারণ রোগীদের ভর্তি নেওয়া কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, চাপ বেড়েছে করোনা রোগীদের। অবস্থা গুরুতর না হলে মানুষ হাসপাতালে যায় না, তাহলে কোন পরিস্থিতিতে হাসপাতালে ভর্তি হবার হার বেড়েছে সেটাও বিবেচনায় নেওয়া আমাদের উচিত।

করোনার সংক্রমণ বেড়ে চলার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার দেশে নতুন করে বিধিনিষেধ দিয়েছে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে এই বিধিনিষেধ কার্যকর হবে। এবার স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় রোধে সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, বিধিনিষেধের আওতায় ১১টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি হচ্ছে, অফিস-আদালতসহ ঘরের বাইরে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। আগামী ১৩ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে এ বিধিনিষেধ কার্যকর করা হবে।

নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে র্যাব সব সময় তৎপর। র্যাব যে কোনো মুহূর্তে সরকারের দেওয়া বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে মাঠে থেকে নিরলসভাবে কাজ করে। ২০২০ সালে ও গত বছরের মাঝামাঝিতে দেশে যখন করোনা সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল তখনো র্যাব মাঠে থেকে বিধিনিষেধ নিশ্চিতে তৎপর ছিল। তখন যারা বিনা কারণে বের হয়েছিলেন ও যারা বাইরে বেরিয়ে সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা করেন র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে ওমিক্রনসহ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার। সরকারের বিধিনিষেধগুলো বাস্তবায়নে কাজ করবে র্যাব। প্রয়োজনে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে সারা দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

গত সোমবার সন্ধ্যায় সরকারের জারি করা বিধিনিষেধে বলা হয়, নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব ও দেশে এ রোগের সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত, দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

১. দোকান, শপিংমল ও বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা এবং হোটেল-রেস্তোরাঁসহ সব জনসমাগমস্থলে বাধ্যতামূলকভাবে সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে। অন্যথায় আইনানুগ শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

২. অফিস-আদালতসহ ঘরের বাইরে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় রোধে সারা দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে।

৩. রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ এবং আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য অবশ্যই করোনা টিকা সনদ প্রদর্শন করতে হবে।

৪. ১২ বছরের ঊর্ধ্বের সব ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক নির্ধারিত তারিখের পরে টিকা সনদ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।

৫. স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরসমূহে স্ক্রিনিংয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পোর্টসমূহে ক্রুদের জাহাজের বাইরে আসার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। স্থলবন্দরগুলোতেও আগত ট্রাকের সঙ্গে শুধুমাত্র ড্রাইভার থাকতে পারবে। কোনো সহকারী আসতে পারবে না। বিদেশগামীদের সঙ্গে আসা দর্শনার্থীদের বিমানবন্দরে প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

৬. ট্রেন, বাস এবং লঞ্চে সক্ষমতার অর্ধেক সংখ্যক যাত্রী নেওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কার্যকারিতার তারিখসহ সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করবে। সর্বপ্রকার যানের চালক ও সহকারীদের আবশ্যিকভাবে কোভিড-১৯ টিকা সনদধারী হতে হবে।

৭. বিদেশ থেকে আগত যাত্রীসহ সবাইকে বাধ্যতামূলক কোভিড-১৯ টিকা সনদ প্রদর্শন ও র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে হবে।

৮. স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন এবং মাস্ক পরিধানের বিষয়ে সব মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা সংশ্লিষ্টদের সচেতন করবেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারগণ এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।

৯. সর্বসাধারণের করোনার টিকা এবং বুস্টার ডোজ গ্রহণ ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় প্রচার এবং উদ্যোগ নেবে। এক্ষেত্রে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেবে।

১০. কোভিড আক্রান্তের হার ক্রমবর্ধমান হওয়ায় উন্মুক্ত স্থানে সর্বপ্রকার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং সমাবেশসমূহ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হবে।

১১. কোনো এলাকার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

এই বিধিনিষেধ কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads