• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

জনশক্তি রপ্তানিতে সুবাতাস

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

করোনা মহামারির মধ্যেও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ডিসেম্বরে ১ লাখ ৩১ হাজার ৩১৬ জন কাজ নিয়ে বিভিন্ন দেশে গেছেন। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই এক মাসে এত বেশি জনশক্তি রপ্তানি হয়নি। এর আগে ২০১৭ সালের মার্চে ১ লাখের কিছু বেশি কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন।

জনশক্তি রপ্তানিকারক ও অর্থনীতির গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির প্রধান বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। দুই বছরের মহামারির ধাক্কা সামলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো এই দেশগুলোও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চাঙা হচ্ছে এসব দেশের অর্থনীতি। সব মিলিয়ে তাদের কাজের লোকের চাহিদা বেড়েছে। তাই বাড়ছে জনশক্তি রপ্তানি। এ কারণে আগামী দিনগুলোতে দেশে রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তারা।

বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে মোট ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন কর্মী গেছেন বিভিন্ন দেশে। নতুন করে শ্রমবাজার না খুললেও পুরনো বাজার থেকেই চাহিদা বাড়ছে। এ ছাড়া খুলতে যাচ্ছে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারও। ইতোমধ্যে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়েছে।

সব মিলিয়ে নতুন বছরে জনশক্তি রপ্তানি আরো বাড়বে বলে মনে করছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ। তিনি বলেন, ডিসেম্বরে জনশক্তি রপ্তানির রেকর্ডে আমরা (সরকার) সত্যিই খুশি। শিগগিরই মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানো শুরু হবে। এবার কঠোরভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর বিষয়টি মনিটর করব। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। এবার সম্পূর্ণ সিন্ডিকেটমুক্ত রেখে কম অভিবাসন খরচে কর্মী পাঠানোর চেষ্টা করব। ফলে সব মিলিয়ে জনশক্তি রপ্তানিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে। আরো বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসবে।

বিএমইটির তথ্যে দেখা যায়, গত বছর যে সোয়া ৬ লাখের মতো কর্মী বিদেশে গেছেন, তাদের মধ্যে জানুয়ারি মাসে গেছেন ৩৫ হাজার ২৩২ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৪৯ হাজার ৫১০ জন এবং মার্চে ৬১ হাজার ৬৫৩ জন। এপ্রিলে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পর গতি কমে যায়। ওই মাসে ৩৪ হাজার ১৪৫ জন কর্মী গেছেন। মে মাসে গেছেন ১৪ হাজার ২০০ জন।

জুন মাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসতে থাকলে আবার সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুনে গেছেন ৪৮ হাজার ৫৬৭ জন, জুলাই মাসে ১২ হাজার ৩৮০ জন, আগস্টে ১৯ হাজার ৬০৪ জন, সেপ্টেম্বর মাসে ৪২ হাজার ৮ জন গেছেন।

অক্টোবরে ৬৫ হাজার ২৩৩ জন, নভেম্বরে ১ লাখ ২ হাজার ৮৬১ জন এবং ডিসেম্বরে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩১৬ জন। ২০২১ সালে মোট জনশক্তি রপ্তানির মধ্যে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জনই গেছেন সৌদি আরবে। অর্থাৎ ৭৪ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গেছেন ২৯ হাজার ২০২ জন, কুয়েতে ১ হাজার ৮৪৮ জন, ওমানে ৫৫ হাজার ৯ জন, কাতারে ১১ হাজার ১৫৮ জন, বাহরাইনে মাত্র ১১ জন, লেবাননে ২৩৫ জন, জর্ডানে ১৩ হাজার ১১৬ জন, লিবিয়ায় ৩ জন, সুদানে ৩৯ জন, মালয়েশিয়ায় ২৮ জন, সিঙ্গাপুরে ২৭ হাজার ৮৭৫ জন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০৮ জন, ইউকেতে ১২৩ জন, ইতালিতে ৬৫৩ জন, জাপানে ৩ জন, ব্রুনাইয়ে ১২ জন, মরিশাসে ২১৫ জন এবং ইরাকে গেছেন ৫ জন।

এদিকে নারী জনশক্তি রপ্তানিও আগের বছরগুলোর চেয়ে বেড়েছে। ২০২১ সালে ৮০ হাজার ১৪৩ জন নারী কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশে গেছেন। জানুয়ারিতে গেছেন ৪ হাজার ৬৬৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৬ হাজার ৩৮২ জন, মার্চে ৮ হাজার ২৯৭ জন, এপ্রিলে ৫ হাজার ২৩৯ জন, মে মাসে ৪ হাজার ২৩৮ জন।

জুনে ৬ হাজার ৯০১ জন, জুলাইয়ে ১ হাজার ৬৯১ জন, আগস্টে ৩ হাজার ৬৫৯ জন, সেপ্টেম্বরে ৮ হাজার ৫৩ জন, অক্টোবরে ৮ হাজার ৪৮৮ জন এবং নভেম্বরে ১০ হাজার ৯৬২ জন নারী কর্মী কাজ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। সবশেষ ডিসেম্বরে গেছেন সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৫৬৪ জন।

নারী কর্মীদের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি সৌদি আরবে গেছেন ৪৬ হাজার ৩৬১ জন। এর পরে জর্ডানে ১১ হাজার ৬৯৭ জন, আর ওমানে গেছেন ৭ হাজার ৬৪৫ জন নারী কর্মী। গত বছর এই তিন দেশেই সবচেয়ে বেশি নারী কর্মী পাঠানো গেছে।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, পণ্য রপ্তানির মতো জনশক্তি রপ্তানিতেও দেশে সুবাতাস বইছে। ডিসেম্বরে আমরা জনশক্তি রপ্তানিতে রেকর্ড গড়েছি। এরই মধ্যে দুটি সুসংবাদ এসেছে।

তিন বছর পর মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে; ফের শ্যমিক যাবে সেখানে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। সেখানে আরও বেশি কর্মী যাবে; আরো বেশি রেমিট্যান্স আসবে। আরেকটি সুখবর হচ্ছে, সরকার ১ জানুয়ারি থেকে রেমিট্যান্সের প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছে। সব মিলিয়ে রেমিট্যান্সে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে আমরা সেই প্রভাব দেখতে পাচ্ছি।

নারীদের কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা দিতে পারলে আরো অধিকসংখ্যক কর্মী শ্রমবাজারে পাঠানো সম্ভব বলে মনে করেন আবুল বাশার।

২০১৯ সালে মহামারি করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজার। মহামারির আগের বছর ২০১৯ সালে ৭ লাখ ১৫৯ জন কর্মী কাজ নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। করোনার ধাক্কায় ২০২০ সালে তা ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জনে নেমে আসে। তবে ২০২১ সালে ধীরে ধীরে তা আবার আলোর মুখ দেখতে শুরু করে; যা বছরজুড়েই গতিতে ছিল। মহামারির আগের সময়ের গতিতে ফিরেছে।

বিএমইটির রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৩০ লাখ বাংলাদেশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজে গেছেন। এই বিশালসংখ্যক জনশক্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্স ইউনিটের (রামরু) তথ্য মতে, গত বছর যে সংখ্যক কর্মী বিদেশে গেছেন, তাদের ৭৪ শতাংশই অদক্ষ। আর ৩ দশমিক ৬ শতাংশ আধা দক্ষ। আর দক্ষ কর্মীর সংখ্যা ছিল ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, জনশক্তি রপ্তানি বাড়ায় এখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও বাড়বে। এ কথা ঠিক যে, চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্সপ্রবাহে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। সেটা কিন্তু গত অর্থবছরের চেয়ে কম। আগের যেকোনো অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে এই রেমিট্যান্সকে কিন্তু কম বলা যাবে না।

করোনা মহামারির মধ্যে সবকিছু বন্ধ থাকায় গত অর্থবছরে পুরো রেমিট্যান্স এসেছিল ব্যাংকিং চ্যানেলে; হুন্ডির মাধ্যমে আসেনি। এখন সব কিছু খুলে যাওয়ায় এবং ব্যাংক রেটের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশ বেশি হওয়ায় সম্ভবত হুন্ডির মাধ্যমেও কিছু রেমিট্যান্স আসছে। সে কারণেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কম দেখা যাচ্ছে। তবে আমার মনে হচ্ছে, রেমিট্যান্স প্রবাহে ফের গতি ফিরে আসবে। সরকার প্রণোদনার পরিমাণ বাড়িয়েছে। বেশি বেশি কর্মী বিদেশে যাচ্ছেন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতিতেও গতি ফিরে এসেছে। এসব কিছুর প্রভাব রেমিট্যান্সে পড়বে।

এদিকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ফের গতি ফিরছে। টানা পাঁচ মাস কমার পর ডিসেম্বরে কিছুটা বেড়েছিল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক। নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে সেই গতি আরো বেড়েছে।

জানুয়ারির ২০ দিনেই দেশে ১২২ কোটি ৪১ লাখ (১.২২ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই ২০ দিনে যে হারে রেমিট্যান্স এসেছে, মাসের বাকি ১১ দিনে যদি সে হারে আসে, তাহলে জানুয়ারিতে মোট রেমিট্যান্সের অঙ্ক গিয়ে ঠেকবে ১৯০ কোটি ডলারে, যা হবে একক মাসের হিসাবে আগের সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২১ সালের জুনে ১৯৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ১ হাজার ২৩ কোটি (১০.২৩ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ২৯৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ২৭০ কোটি ডলার বা ২০ দশমিক ৯ শতাংশ। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি বেড়েছিল ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বেড়েছে ২৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads