• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

ওয়াসার প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী

  • রেজাউল করিম হীরা
  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

করোনা মহামারিতে কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। সেইসাথে নিত্যপণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মধ্য ও নিম্নবিত্তের জীবন। এমন পরিস্থিতিতে আবারো পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। গত ১৩ বছরে ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ১৪ বার।

গত সোমবার ঢাকা ওয়াসার বিশেষ বোর্ড সভায় পানির দাম ৪০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। বোর্ডের অধিকাংশ সদস্য এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কিন্তু ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তারপরও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবটি পাঠাতে চাইছে। সেখানে প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলেই ফের বেশি দামে পানি কিনতে হবে রাজধানীবাসীকে।

পানির দাম বাড়ানোর এই প্রস্তাবের খবরে তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন নগরবাসী। তাদের অভিযোগ, যেখানে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ ওয়াসা। সেখানে পরিচালন ব্যয়, ঘাটতি ও ঋণ পরিশোধের অজুহাতে আবাসিক এবং বাণিজ্যিক খাতে ঢাকা ওয়াসার পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব হাস্যকর, অযৌক্তিক এবং গ্রাহকের ওপর নির্যাতনমূলক।

ঢাকার কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার শহীদ রানা বলেন, সরকার চুরি বন্ধ করতে পারে না, এর দায় চাপায় সাধারণ মানুষের ওপর। আগে তার ছয়তলা বাড়ির জন্য পানির বিল আসত মাসে ১০ হাজার টাকার মতো। দাম বাড়লে অন্তত চার হাজার টাকা বেশি দিতে হবে। তিনি বলেন, এই টাকা আমি দেব কোথা থেকে? আসলে আমাদের চতুর্দিক থেকে শুষে নেওয়া হচ্ছে। তারা যেটা করবে সেটাই মেনে নিতে হবে।

জানা গেছে, নিরাপদ পানি সরবরাহে ব্যর্থ হলেও গত দুই বছরে দুবার আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ বছরে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ১৪ বার। যদিও পানির মান নিয়ে সাধারণ মানুষের অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি।

এরআগে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজশাহী পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ-ওয়াসা পানির দাম বাড়িয়েছে তিন গুণ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন রাজশাহীর সব শ্রেণিপেশার মানুষ। প্রতিদিনই সেখানে চলছে মিছিল, বিক্ষোভ সমাবেশ, মানববন্ধন। তারা বলছেন, দাম বাড়াতে হলে সার্ভিস কোয়ালিটি আগে বৃদ্ধি করতে হয়।  কিন্তু পানির কোয়ালিটি নিম্নমানের রেখে দাম ঊর্ধ্বমুখী এটা মেনে নেওয়া যায় না। এছাড়া করোনাকালে কাজটা উচিত হয়নি ওয়াসার।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজশাহীতে আবাসিক পানি যা ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতি হাজার লিটারে ২ টাকা ২৭ পয়সা ছিল, তা বাড়িয়ে করা হয়েছে প্রতি হাজার লিটার ৬ দশমিক ৮১ টাকা। এছাড়া বাণিজ্যিক পানির দাম, যা আগে প্রতি হাজার লিটার ছিল ৪ টাকা ৫৪ পয়সা, তা বাড়িয়ে ১৩ টাকা ৬২ পয়সা করা হয়েছে। আর নতুন মূল্য ভবনে ব্যবহূত পাইপের ব্যাস ও তলার ভিত্তিতে করা হবে।

রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ১ হাজার লিটার পানি কিনতে হয় ১৫ টাকা ১৮ পয়সায়। ওয়াসার প্রস্তাব অনুযায়ী আবাসিকে এ দর ২১ টাকা ২৫ পয়সা করার কথা বলা হয়েছে। আর বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম বর্তমানে ৪২ টাকা। ওয়াসার প্রস্তাব অনুযায়ী, বাণিজ্যিক সংযোগে পানির দাম দাঁড়াবে ৫৮ দশমিক ৮ টাকা। ঢাকা ওয়াসা আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন দর কার্যকর করতে চায়।

জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, ওয়াসা কর্তৃপক্ষ উৎপাদন খরচের সঙ্গে পানির দাম সমন্বয় করতে চায়। অবশ্য বোর্ডের অধিকাংশ সদস্য এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।

বর্তমানে ওয়াসার বোর্ড সভার সদস্য ১৩ জন। এরমধ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের দুজন অতিরিক্ত সচিব, পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি ছাড়াও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সদস্য হিসেবে থাকেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই সদস্য বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সংকটে রয়েছেন। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। সার্বিক বিবেচনায় এখনই দাম বাড়ানো ঠিক হবে না বলে অধিকাংশ সদস্য সভায় মত দিয়েছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কাউন্সিলর ও ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সদস্য মামুন রশিদ শুভ্র বলেন, ওয়াসার পক্ষ থেকে পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব ও যুক্তি তুলে ধরা হয়। বলা হয়, এরই মধ্যে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। পানি উৎপাদনে বিদ্যুৎ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া পানির জন্য প্রতি বছর ওয়াসাকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এই ভর্তুকি থেকে ওয়াসাকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য পানির দাম বাড়ানো প্রয়োজন। তবে আমি বলেছি, করোনার এই সংকটকালে কোনোভাবেই পানির দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। কিন্তু তারা মন্ত্রণালয়ে পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠাতে চাইছেন। তারা বলছেন, মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে তখন এটা কার্যকর হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন বোর্ড সদস্য বলেন, এবার ৩৮ শতাংশ পানির দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাবে ৯৯ শতাংশ বোর্ড সদস্য আপত্তি জানিয়েছেন। কিন্তু ওয়াসা কর্তৃপক্ষ তারপরও প্রস্তাব পাঠাতে চাইছে। এ ছাড়া ওয়াসায় আরো অনেক ঘটনা ঘটছে। কিছুদিন পর প্রয়োজনে তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সেসব ঘটনা প্রকাশ করবেন।

বোর্ডের অপর এক সদস্য বলেন, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে পানির দামও বাড়লে মানুষের কষ্টের শেষ থাকবে না। তবে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যেভাবে যুক্তি তুলে ধরেছে, তাতে মনে হয়েছে দাম বাড়বেই। এর আগে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহেও একবার পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বোর্ড সভায় তোলা হয়েছিল। তখনো বেশিরভাগ সদস্য বিরোধিতা করেন।

তিনি জানান, গত সোমবার আবারো প্রস্তাব আসে। ওয়াসা বোর্ডে থাকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক পানির দাম ৪০ শতাংশ বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে বোর্ডের অধিকাংশ সদস্য এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাম বাড়াতে চান, আমরা বলেছি দাম বাড়ালে মানুষের জীবনমানের ওপর এর প্রভাব পড়বে। ফলে এটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

অবশ্য এ মতামত গুরুত্ব পাচ্ছে না বলেই ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সূত্র জানিয়েছে। কারণ, ওয়াসার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের অবস্থানই প্রাধান্য পায়। তিনি গতকালের (সোমবার) সভায় পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে সবচেয়ে তৎপর ছিলেন। সূত্রের দাবি, সভায় দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের উচ্চ মহলের সায় আছে বলেও উল্লেখ করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

এ বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বলেন, ওয়াসা বোর্ডের সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না। তবে কস্টিং এবং সিস্টেম লস কমানো এবং সরকারের ভর্তুকি কমানো যায় কীভাবে, সেসব বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

করোনাকালে গত বছরের ২৫ মে ঢাকা ওয়াসা পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ায়। যাতে আবাসিকে ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা প্রতি ইউনিট (এক হাজার লিটার) পানির দাম ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা পয়সা থেকে বেড়ে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা হয়। আর বাণিজ্যিক সংযোগে প্রতি ইউনিট পানির দাম ৪০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা করা হয়।

এরআগে ২০২০ সালের এপ্রিলেও পানির দাম বাড়িয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। তখন আবাসিকে প্রতি ইউনিটের দাম বেড়েছিল ২ টাকা ৯০ পয়সা। আর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, ২০১৮ সালের জুলাইতে, ২০১৭ সালের আগস্টে পানির দাম বাড়ায় ওয়াসা, তাদের ভাষায়, এটা ‘মূল্য সমন্বয়’।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads