• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

জন্মদাত্রীকে আজো খুঁজে ফেরেন যুদ্ধশিশুরা

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো জন্মদাত্রীকে খুঁজে ফিরছেন যুদ্ধশিশুরা। প্রাণপ্রিয় মা-কে খুঁজতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তারা ছুটে আসেন বাংলাদেশে। চষে বেড়ান গ্রাম-গ্রামান্তর। যোগাযোগ করেন সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা ধর্ষিত হন লাখো বাঙালি নারী। সরকার এসব নির্যাতিতাকে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব প্রদান করেছে। এর মধ্যে অনেকেই সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। এসব সন্তানকেই বলা হয় যুদ্ধশিশু।

এই যুদ্ধশিশুদের অনেকেই এখনো খুঁজে ফেরেন তাদের মাকে। অনেকেই আবার পালিত বাবা-মায়ের ছায়াতলে থেকে পেয়েছেন খ্যাতিও। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর, মিশনারিজ অব চ্যারেটিজসহ যুদ্ধশিশুদের নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধন থেকে পাওয়া যায় এসব তথ্য।

যুদ্ধশিশুদের প্রকৃত সংখ্যা কত এর সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে ৭০০ যুদ্ধশিশুর ফাইল আছে। লন্ডনভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যান্ড প্যারেন্টহুড ফেডারেশনের (আইপিপিএফ) হিসাব অনুযায়ী এই সংখ্যা দু’লাখ। তবে তৎকালীন সময়ে একটি ইতালীয় চিকিৎসক দলের সমীক্ষা অনুযায়ী যুদ্ধশিশু জন্মদানকারী নারীর সংখ্যা চল্লিশ হাজার। আবার ওই সময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকায় বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ২৩ হাজার নির্যাতিতা নারীর গর্ভপাত ঘটান হয়। দুস্থ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ডের সভাপতি বিচারপতি কেএম সোবহান, মিশনারিজ অব চ্যারিটির সিস্টার মার্গারেট মেরি এবং আইপিপিএফ-এর ড. জিওফ্রে ডেভিস, ওডার্ট ফন শুল্জ প্রমুখের সাক্ষাৎকার ছিল ওইসব প্রতিবেদনে।

যুদ্ধপরবর্তী সময়ে বিদেশি চিকিৎসক দল ঢাকায় ‘সেবা সদন’ নামে পরিচিত বেশ কয়েকটি চিকিৎসা কেন্দ্র গড়ে তোলেন। দেশব্যাপী স্থাপিত ২২টি সেবা সদনে তিনশ থেকে চারশ শিশুর জন্ম হয়েছিল বলে জানা যায়।

দুটি লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্যাতিতা নারীদের জন্য বাংলাদেশ মহিলা পুনর্বাসন বোর্ড  (বিডব্লিউআরবি) গঠিত হয়। প্রথমটি হলো, ধর্ষিতাদের তিন থেকে চার মাসের মধ্যে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়া। দ্বিতীয়টি ছিল, হাজার হাজার নির্যাতিতার দ্রুত কার্যকর পুনর্বাসনের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা।

যুদ্ধশিশুদের আন্তদেশীয় দত্তক গ্রহণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত অনুরোধে প্রথম যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটি যুদ্ধশিশুদের সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ দিতে এগিয়ে আসে, সেটি হলো জেনেভাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস (আইএসএস)-এর যুক্তরাষ্ট্র শাখা। দুটি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, ঢাকাভিত্তিক বাংলাদেশ সেন্ট্রাল অরগানাইজেশন ফর উইমেন রিহ্যাবিলিটেশন এবং বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, আইএসএস-এর সঙ্গে পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পর্যায়ের পুরো সময় একত্রে কাজ করেছিল।

বিদেশি নাগরিকরা যাতে যুদ্ধশিশুদের সহজে দত্তক নিতে পারে সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ পরিত্যক্ত শিশু (বিশেষ বিধান) আদেশ ১৯৭২ নামে একটি রাষ্ট্রপতি আদেশ জারি করা হয়। জানা যায়, কানাডাই প্রথম যুদ্ধশিশুদের দত্তক গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করে। ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই ১৫ যুদ্ধশিশুর প্রথম দলটি বাংলাদেশ থেকে কানাডায় পৌঁছায়। পরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়া এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হোল্ট অ্যাডাপশন প্রোগ্রাম ইন্ক এবং টেরি ডেস হোমস-এর মতো অনেক সংগঠনও এগিয়ে আসে।

এসব যুদ্ধশিশুর অনেকেই প্রতিনিয়ত জন্মদাত্রী মা-কে খুঁজতে আসেন বাংলাদেশে। দেশের নানা প্রান্তে ছুটে যান তারা। যুদ্ধশিশুদের মধ্যে কেউ কেউ এখন বিশ্বখ্যাত। কেউবা জেনেও যেতে পারেননি তার জন্ম ইতিহাস। যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে (সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর, ই-মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ, গনমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, বাংলাপিডিয়া) অনুসন্ধান করে বেশ কয়েকজন যুদ্ধশিশুর বিষয়ে জানা যায়।

এর মধ্যে রায়ান গুড একজন। বাংলাদেশ থেকে প্রথম যে ১৫টি যুদ্ধশিশু কানাডায় যায়, সেই দলে ছিলেন রায়ান। মায়ের খোঁজে বাংলাদেশে আসা প্রথম যুদ্ধশিশু তিনিই। ১৯৮৯ সালে যুদ্ধশিশুদের একটি দল প্রথম বাংলাদেশে আসে। সেই দলে ছিলেন রায়ান। তিনি কানাডার ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ ও সম্পদ বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। জন্মদাত্রী মা-কে খুঁজতে তিনি প্রথমে যান পুরান ঢাকার শিশু ভবনে। কিন্তু সেখান থেকে তিনি কোনো তথ্য পাননি। পরে তার অনেক জোরাজুরির পর সেখানে কর্তব্যরতরা ফাইল খুঁজে শুধু তাকে এটুকু জানান যে, তা মায়ের গ্রামের বাড়ি ছিল বরিশালে। তিনি ছুটে যান বরিশালে। কিন্তু সেখানেও হতাশ হতে হয় তাকে। পরে তিনি যান কলকাতায় মিশনারিজ অব চ্যারেটির প্রধান কার্যালয়ে। আবারও হতাশ হতে হয় তাকে।

কিন্তু তারপরও থেমে থাকেননি রায়ান। মা-কে খুঁজতে তিনি ১৯৯৮ সালে আবারো আসেন বাংলাদেশে। তবে প্রতিবারই একবুক হতাশা নিয়ে ফিরে যেতে হয় তাকে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি জন্মে যায় তার এক তীব্র আকর্ষণ। তাই বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন রায়ান। একপর্যায়ে পেয়েও যান তিনি। শিশু ভবনের তথ্য অনুযায়ী রায়ানের জন্ম ১৯৭২ সালের ২৭ জুন।

জানা গেছে, রায়ানের সাথে কানাডায় যায় রানীও। তাকেও দত্তক নেন ম্যাসাকাটুসন শহরের ইউনির্ভাসিটি অব সাসকাচিওনের অধ্যাপক ড. রবিন মরাল ও বারবারা মরান। তার জন্ম ১৯৭২ সালের ৩০ মার্চ। জন্মের সময় তার ওজন ছিল মাত্র এক কেজি। খুবই রোগাপাতলা হওয়ার কারণে তাকে নিয়ে যথেষ্ট কাঠখড় পোহাতে হয় তার পালক পিতা-মাতাকে। তারা ছিলেন খুবই ধনী। বিত্তবৈভবের মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন রানী। ছোটবেলা থেকে খুব মেধাবী ছিলেন রানী। ছোটবেলাতেই বেহালা আর বাঁশি বাজাতে পারতেন। এত অল্প বয়সে তার গান-কবিতা শুনে অবাক হয়ে যেত প্রতিবেশীরা। তিনি জানতেন তার জন্ম ইতিহাস। ১৬ বছর বয়সে তার ভেতর কিছু পরিবর্তন ঘটতে থাকে। অদেখা মা-কে দেখতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তিনি। কেন তাকে পরিত্যাগ করা হলো জানতে উিগ্রব হয়ে ওঠে রানী। তিনি মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত্ত হয়ে পড়েন যে, ১৯৯২ সালে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে তিনি বাইলেঙ্গুয়াল ডিপ্লোমা নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করেন। পরে পড়াশোনা করেন নার্সিং বিষয়ে। ১৯৮৯ সালে তার পালক পিতা-মাতা আরো ৪ যুদ্ধশিশুর সাথে তাকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন-এই আশায় যদি এতে তার মানসিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়। বাংলাদেশে এসে তিনি যান শিশু ভবনে। সেখানে তিনি জানতে চান কেন, কোন পরিস্থিতিতে তাকে ফেলে চলে যান তার মা। বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে তার মানসিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। তীব্র বিষণ্নতা পেয়ে বসে থাকে। ১৯৯৯ সালের ৭ জুন ২৭ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন তিনি।

কানাডায় থাকা আরেক যুদ্ধশিশুর নাম মারি কোহিনুর নোর্ডবার্গ। তাকে দত্তক নেন এক কানাডিয়ান দম্পতি। কোহিনুর এখন একজন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী। ২০১১ সালে তিনি তার মা-কে খুঁজতে প্রথম বাংলাদেশে আসেন। সে সময় গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, শুধু তিনি নন-কানাডায় তার মতো শতাধিক যুদ্ধশিশু আছে।

যুদ্ধশিশু লারা জরিনা মরিসও থাকেন কানাডায়। ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টে ডিপ্লোমাসহ বেশকিছু বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করেন জরিনা। আর কানাডার সিটিজেন হলেও এখন থাকেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। সেখানে একটি আন্তর্জাতিক  স্কুল দুবাই-আল-খাইনে শিক্ষকতা করছেন।

এছাড়া কানাডায় বসবাসকারী রুফিয়া এখন সেখানকার একটি ব্যাংকে চাকরি করেন। আর বাংলাদেশ থেকে দত্তক নেওয়া আর্টিও রিবেইরো একমাত্র যুদ্ধশিশু, যিনি জেনে যেতে পারেননি তার জন্ম ইতিহাস। কারণ তিনি ছেলেন মানসিক রোগে আক্রান্ত। ২০১০ সালে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

সম্প্রতি সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে যুদ্ধশিশুদের বিষয়ে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাঈদা আকতার জানান, প্রায়ই যুদ্ধশিশুদের অনেকে আমাদের এখানে আসেন জন্মদাত্রী মায়ের বিষয়ে খোঁজ করতে। যুদ্ধশিশুরা তাদের মায়ের খোঁজে বাংলাদেশে এলে প্রথমে যোগাযোগ করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। তারা বিক্ষিপ্তভাবে খোঁজ করতে থাকেন। তাদের সহায়তা করতেই আমরা একটি ডিজিটাল আর্কাইভ করার উদ্যোগ নিয়েছি, যাতে যুদ্ধশিশুদের যতটা সম্ভব এ বিষয়ে তথ্য দেওয়া যায়। তবে এটি এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে। তিনি আরো জানান, মিন্টু নামে এক ব্যক্তি সম্প্রতি ডেনমার্ক থেকে বাংলাদেশে আসেন তার মায়ের খোঁজে। তিনি তার মায়ের খোঁজও পেয়েছেন বলে দাবি করেন। ডিএনএ টেস্টের জন্য অনুমতি পাওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে তিনি যোগাযোগ করেন সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে।

পুরান ঢাকার মিশনারিজ অব চ্যারিটিজের প্রধান সিস্টার জেভিয়ান জানান, তাদের এখানেও অনেক যুদ্ধশিশু আসেন তাদের জন্মদাত্রীদের খোঁজে। কিন্তু এখান থেকে তাদের কোনো তথ্য দেওয়ার নিয়ম নেই। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ওইসব মা হয়তো এখন নিজেদের সংসার নিয়ে সুখে আছেন। তাদের ওই সন্তানদানের ইতিহাস হয়তো অনেকেই জানেন না। তারাও তা জানতে দিতে চায় না। সেসব ইতিহাস প্রকাশ পেলে সামাজিক-পারিবারিকভাবে তারা নানান সমস্যায় পড়তে পারেন। তাই এ ধরনের কোনো তথ্য কাউকে দেওয়া হয় না বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads