বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময়কালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাতেগোনা কয়েকটি কাগজ প্রকাশিত হতো। দৈনিক কাগজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক মিল্লাত, দৈনিক ইনসাফ এবং মুসলীম লীগ সমর্থিত মর্নিং নিউজ। এছাড়া সাপ্তাহিক সৈনিক, ইত্তেফাক, নওবেলাল-এর পাশাপাশি জিন্দেগী ও চাষী ছিল সময়ের সাপ্তাহিক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনাটিকে এই পত্রিকাগুলো ব্যাখ্যা করেছিল নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে।
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘মর্নিং নিউজ’ কাগজে দুটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। তার একটি ছিল ২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণ ও ছাত্রদের আচরণ নিয়ে। এই পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনকে ভারতের মদদে হিন্দুদের সংঘটিত বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করে। এ ধরনের বিকৃত সংবাদ পরিবেশনের জন্য বিক্ষুব্ধ জনগণ ‘মর্নিং নিউজ’-এর অফিস ও প্রেস পুড়িয়ে দেয়। দৈনিক ‘আজাদ’ প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিনের মালিকানাধীন হওয়া সত্ত্বেও এর প্রায় সব সাংবাদিকই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সমর্থক। গুলিবর্ষণের ঘটনাটি ২২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘দৈনিক সংবাদ’-এ অনেকটা দায়সারাভাবে প্রকাশিত হয়। ক্ষুব্ধ জনতা সংবাদ অফিস আক্রমণে উদ্যত হয়। তখন এ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী, তসদ্দুক আহমদ, কেজি মুস্তাফা, সরদার জয়নুদ্দিন প্রমুখ। আর খায়রুল কবীর ছিলেন দৈনিক সংবাদের সম্পাদক।
তদানীন্তন প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরাম খাঁর মালিকানাধীন ‘দৈনিক আজাদ’ ২১ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় বিশেষ জরুরি সংখ্যা ‘টেলিগ্রাম’ প্রকাশ করে। তখন প্রাদেশিক পরিষদের সরকারদলীয় সদস্য ‘আজাদ’ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ঘটনার প্রতিবাদে স্পিকারের কাছে এক চিঠিতে নিজের লজ্জার কথা জানিয়ে পদত্যাগ করেন। এ সময় আজাদের বার্তা সম্পাদক ছিলেন একাত্তরের শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। তিনি তখন ‘ভাষা আন্দোলনের ডায়েরি’ নামে একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লেখেন। প্রায় সপ্তাহব্যাপী ‘দৈনিক আজাদ’ এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশের মাধ্যমে এক অনবদ্য ভূমিকা রাখে। কিন্তু সরকারের উচ্চমহলের চাপে ‘আজাদ’ দৈনিকটির বিপ্লবী ভূমিকা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে।
ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল সেই সময়ে মোহাম্মদ মোদাব্বের সম্পাদিত ‘দৈনিক মিল্লাত’। গুলিবর্ষণে নিহতদের ঘটনাবলি কাগজটি ব্যানার হেডিংয়ে প্রকাশ করে। তাদের আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘রাতের আঁধারে এত লাশ যায় কোথায়?’ সাপ্তাহিকগুলোর মধ্যে সৈনিক, ইত্তেফাক এবং নওবেলাল ছিল নিজস্ব ভূমিকায় উজ্জ্বল।
তবে ১৯৫২-এর ২১ তারিখের ঘটনা নিয়ে সরকার একটি প্রেসনোট পাঠায় পত্রিকাগুলোতে। সেই প্রেসনোটে ছাত্র-জনতার হত্যার কোনো উল্লেখ ছিল না। এভাবে সত্য, মিথ্যা আর সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে সারা দেশে বাঙালির বাংলা ভাষা আন্দোলনের সংবাদ পৌঁছে যায়। যাকে আর পরবর্তীসময়ে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে।