• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

সংসার চলছে না নিম্নবিত্তের

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

পণ্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা নিম্নবিত্ত। প্রতিনিয়ত আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে গলদঘর্ম মধ্যবিত্তও। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এখন আগুন নয়, তুলনা করা হচ্ছে দাবানলের সঙ্গে। চাল-ডাল-তেল থেকে শুরু করে অতিপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দামের একই অবস্থা। নিত্যপণ্যের দামের এমন ঊর্ধ্বমুখীর জন্য করোনা মহামারিতে উৎপাদন কমে যাওয়া, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতা, সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ও সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। আবার কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ বাজারের সুশাসনের অভাবকেও দায়ী করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নতুন বছর ২০২২ শুরু থেকেই নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন। এতে অব্যাহতভাবে বাড়ছে মূল্যস্ফীতির হার। বিশেষ করে সয়াবিন তেল, ডাল, চিনির দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় বেশি। গত ডিসেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির বলেন, আগে টিসিবির লাইনে নিম্নআয়ের মানুষেরাই দাঁড়াতেন। এখন মধ্যবিত্তরাও দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে বাড়ছে না আয়। ফলে টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। টিসিবির লাইনে দাঁড়ানো ছাড়া তাদের উপায় নেই।

রাজধানীর বাসাবো এলাকার দিনমজুর আব্দুল মাজিদ বলেন, চাল-ডাল থেকে তেল-নুনসহ এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। যা আয় করি তা দিয়ে এখন আর কোনোভাবেই সংসার চলছে না! তাই কাজ শেষে বাসায় যাওয়ার সময় রাস্তায় কম দামে যে সবজি পাই তা-ই কিনে নিই। আব্দুল মাজিদের মতো নিম্নআয়ের অনেক মানুষ এখন দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে পিষ্ট। জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন এসব শ্রমজীবী। আয় কম খরচ বেশি হওয়ায় আয়-ব্যয়ের হিসাব কষতে এখন দিন পার করছেন তারা। বাজারের আগুনে শুধু নিম্নআয়ের মানুষ নয়, মধ্যবিত্তরাও দিশেহারা বলে জানা গেছে। একই অবস্থা প্রবাসীদের পরিবারেরও। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জাহিদ হাসান জানান, জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় মাসের হিসাব কষতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। জাহিদ বলেন, বাজারে এলেই হাজার টাকা শেষ। মাস শেষে বেতন পাই কত? বাচ্চাদের জন্য দুধ কিনতে হয়। মাসে ছয়টা প্যাকেট লাগে। আগে প্রতি প্যাকেট ৩৪০ টাকায় কিনতাম; এখন ৩৭০ টাকা। ১৮ টাকার সাবান এখন ২২ টাকা। তেলের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চাল-ডালসহ সব নিত্যপণ্যেরই দাম বেশি। মাস শেষে ঘরভাড়াসহ সংসারের অন্যান্য খরচ মেটাতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে।

লিটন নামে আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী বলেন, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, কিন্তু বেতন বাড়ে না। নির্দিষ্ট বেতন, সারা মাস হিসেব করে চলতে হয়। নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা জরুরি। দোকানদার ইচ্ছেমতো দাম নিচ্ছে, একেক দোকানে একেক দাম।  দোকানদাররা বলছেন, পাইকাররা দাম বাড়ালে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়াতে হয়। পাইকারিতে বাড়ে কেন, তা জানা নেই। 

প্রবাসীরাও করোনার কারণে দেশে আগের মতো টাকা পাঠাতে পারছে না। যার কারণে প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর পরিবারেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়ছে। 

চকবাজারে কথা হয় প্রবাসীর স্ত্রী হোসনে আরার সঙ্গে। তিনি বলেন, করোনার কারণে অনেক হিসাব করে চলতে হচ্ছে। আগে যখন যেটা ইচ্ছা, সেটা বাজার থেকে নিয়ে গেছি। এখন বাজার করার জন্য পরিকল্পনা করে আসতে হয়। সবকিছুই হিসাব করে নিয়ে যাই। প্রবাসে স্বামীর আয়ে ভাটা পড়েছে। 

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মতিঝিল, খিলগাঁও, মুগদা ও সেগুনবাগিচা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারের সবচেয়ে সস্তা পাঙ্গাশ মাছের দামও কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। এক কেজি ওজন বা মাঝারি আকারের পাঙ্গাশ ১৫০ টাকা আর বড় পাঙ্গাশ বিক্রি হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকায়। রুই-কাতলা মাছ আকারভেদে ২৮০-৪০০ টাকা, নওলা ২৫০ টাকা কেজি, কালবাউশ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি, শিং,  মাগুর ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা, ট্যাংরা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, আইড় মাছ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। চাষের কই বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়, যা গত সপ্তাহেও বিক্রি হয়েছে ২০০-২৫০ টাকায়। তেলাপিয়া কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৬০-২৫০ টাকা। এছাড়া প্রতি কেজি চিংড়ি আকারভেদে ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি, ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা কেজি। গত সপ্তাহেও এই আকারের ইলিশের দাম ছিল ৬০০ টাকা।  

শীতের মৌসুমে সবজির দাম সাধারণত কম থাকে। কিন্তু এবার ছিল তার ব্যতিক্রম। ঢাকার বাজারগুলোতে গড়ে প্রতি পিস মাঝারি আকারের ফুলকপি ৩৫-৪০ টাকা আর বড় আকারের ফুলকপির দাম ৫০ টাকা, বাঁধাকপি ৩০-৪০ টাকা, শিম প্রতি কেজি ৬০ টাকা, বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা, শালগম ৪০ টাকা, করলা ৭০, চিচিঙ্গা ৫০ টাকা, কচুরমুখি ৫০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা। খিরা ৪০, পেঁপে ৩০, গাজর ৪০, টমেটো ৩০ থেকে ৪০ টাকা, মূলা ৩০ থেকে ৪০ টাকা আর আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ টাকায়।

রাজধানীর বাজারগুলোতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ডিমের দাম। গত সপ্তাহে ১১০ টাকায় এক ডজন ফার্মের মুরগির ডিম এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। এছাড়া গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকায় আর খাসির মাংসের কেজি ৯০০ টাকা।

এদিকে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও অনেক বেড়েছে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে বাড়েনি আয়। ফলে টিসিবির লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। টিসিবির ট্রাক থেকে কেউ যদি দুই কেজি করে তেল, দুই কেজি ডাল, দুই কেজি চিনি এবং তিন কেজি পেঁয়াজ কেনেন, তাতে খরচ হচ্ছে ৫৫০ টাকা। খুচরা বাজার থেকে একই পরিমাণ পণ্য কিনতে লাগছে ৮৪০ টাকা। ফলে একজন ক্রেতার সাশ্রয় হচ্ছে ২৯০ টাকা। তবে এই ২৯০ টাকা বাঁচাতে টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।

ভোক্তার অধিকার নিয়ে কাজ করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। সংগঠনটির মতে, সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে, যদি সরকার দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী লাগাম টেনে ধরতে না পারে কিংবা আয়বৈষম্য কমানো না যায়।

ক্যাবের সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনীতি মুদ্রাস্ফীতির নেতিবাচক প্রভাবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপীই এক ধরনের মুদ্রাস্ফীতির প্রবণতা রয়েছে। আমাদের আমদানি ও রপ্তানি বেড়েছে, বেড়েছে তারল্য প্রবাহ। যার প্রভাব বাজারেও এসেছে। 

তিনটি কারণ ব্যাখ্যা করে ক্যাব সভাপতি বলেন, প্রথমত করোনার কারণে অনেক পণ্যেরই উৎপাদন কমে গেছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে জাহাজ ভাড়া বেড়ে গেছে। যার ফলে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বর্তমানে চাল থেকে শুরু করে সকল পণ্য এখন আমদানিনির্ভর। কোনো কোনো পণ্য ৮০-৯০ শতাংশ, কোনো পণ্য ৫-১০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। কম পরিমাণ আমদানি হলেও সরবরাহ চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের সুযোগসন্ধানী আচরণ। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম বাড়ে তখন সাথে সাথে দেশের অভ্যন্তরে পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। যখন দাম কমে, তখন পণ্যের দাম কমার প্রবণতা দেখা যায় না। এ বিষয়টি ব্যবসায়ীদের খাতায়ই নেই।

সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত ভোক্তাদের বিপক্ষে যাচ্ছে এমন মন্তব্য করে তৃতীয় কারণের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যেমন- ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম ওই সময় বৃদ্ধি না করলেও চলত। কারণ, বিগত কয়েক বছর জ্বালানি বিভাগ প্রচুর লাভ করেছে। আমরা সবসময় বলে এসেছি ভর্তুকির দরকার নেই, যখন বেশি দামে জ্বালানি তেল বিক্রি হয়েছে, তা দিয়ে একটি ‘প্রাইস স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড’ তৈরি করা হোক। যা দিয়ে যখন দাম বাড়বে তখন সেটা সমন্বয় করা যায়। কিন্তু তারা সেটা না করে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয় ও বাকি টাকা  সরকারকে দেয়।

গোলাম রহমান বলেন, নিম্নআয়ের মানুষের জীবনযাত্রার চেয়ে বর্তমান সরকারের প্রধান ফোকাসের জায়গায় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রবৃদ্ধি। আয়বৈষম্য বেশ বেড়েছে। যার সাথে আইয়ুব সরকারের মিল পাচ্ছি। তখন ২২ পরিবারের প্রসঙ্গটা বেশ সাড়া ফেলেছিল। বর্তমানে উন্নয়নের মহাসড়কে আছি, কিন্তু উন্নয়নের মহাসড়কে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যদি পিষ্ট হয়ে যায় তাহলে সেই উন্নয়ন আমাদেরকে পিষ্ট করবে। সরকারের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাবে, যদি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বমুখী লাগাম টেনে ধরা না যায়। অথবা আয়বৈষম্য কমানো না যায়। এক সময় আমরা বলতাম নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন, এখন বলি বাজারে দাবানল চলছে।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার বর্তমান সংকটে বাজারে নতুন কোনো প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই বিশ্ববাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে।

অন্যদিকে, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায় সুশাসনের অভাবকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী করছেন।

সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এ বিষয়ে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, এটি সত্যিই উদ্বেগের বিষয়। অতিমারির সময় মানুষের আয় কমে গেছে, কর্মসংস্থান নেই অনেকের। তার ওপর জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণেও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায় সুশাসনের অভাব থাকে, যে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাস্তবতার আলোকে মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য মূল্যস্ফীতির বিরাট ফারাক রয়েছে।

অন্যদিকে লাগামহীন পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সাময়িক সময়ের জন্য কর কাঠামো পুনর্বিন্যাস করার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।

তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এছাড়া কাঁচামালের বহু কারখানা বিদেশে বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে রাসায়নিক কারখানা। এমন প্রেক্ষাপটে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা আগেই শুল্ক-কর কমানোর সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু সুপারিশ রাখা হয়নি। এসব কারণে এখন বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। সামনে পবিত্র রমজান, এখনই দ্রব্যমূল্য নিয়ে দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads