• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের টাকা নেয় কারা

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের টাকা নেয় কারা

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মধ্যপ্রাচ্যগামী ভিজিট ভিসায় যাত্রীদের বিমানবন্দর কন্ট্রাক্টের নামে নেওয়া হচ্ছে টাকা। যাত্রীপ্রতি টাকার পরিমাণ ২৫ থেকে ৩০ হাজার। পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হলেও একেবারে ওপেন সিক্রেটভাবেই নেওয়া হচ্ছে এ টাকা। আবার যারা টাকা দেন না তাদের আটকেও দেওয়া হচ্ছে। টাকা দিলে যেতে পারে আবার টাকা না দিলে আটকে দেওয়া হচ্ছে।

একদিকে পুলিশ টাকা না দেয়ার জন্য সতর্ক করলেও টাকা না পেলে পাসপোর্ট অফলোড করে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে বিমানবন্দরে পুলিশের নামে উঠানো টাকা আসলে কারা পায়। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, মালয়েশিয়াগামী যাত্রীরা অনেক সময় বিমানবন্দর কন্ট্রাক্ট করে যায়।

লোকজন বলছেন, বিমানবন্দর কন্ট্রাক্ট করে অনেকেই যাচ্ছে। যারা যাচ্ছে তাদের আসলে কোনো না কোনো পেপারস শর্টস থাকছে। এ কারণে তারা এভাবে পার হয়ে যাচ্ছে। ইমিগ্রেশন, এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে তারা পার হয়ে যাচ্ছে। এটি মানবপাচারের মধ্যেই পড়ে।

ইমিগ্রেশন পুলিশের ডিআইজি মনিরুল ইসলাম বলেন, এটা একটা বড় সমস্যা। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে করে কেউ ইমিগ্রেশন পুলিশের নাম করে কারো কাছ থেকে টাকা না নিতে পারে। এ জন্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আমরা প্রতিনিয়ত সতর্কতামূলক পোস্ট দিই।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা অবশ্যই মানবপাচারের মধ্যেই পড়ে। ভিজিট ভিসায় যাওয়ার ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে তারা অবৈধ হয়ে যায়। তখন তারা সেখানে বিপদে পড়ে। একদিকে যেমন সে নিজের ক্ষতি করলো অপরদিকে দেশের ভাবমূর্তিও সে নষ্ট করলো।

তিনি বলেন, আমরা এমনটি চাই না। এর সঙ্গে যারা জড়িত এদের ব্যাপারে সবাই যেন সতর্ক থাকে।

সূত্রমতে, কন্ট্রাক্ট বাণিজ্য ভিসা, টিকিটের মতো হয়ে গেছে। ভিসা-টিকিট না থাকলে যেমন বিদেশ যাওয়া যায় না, তেমনি এখন ভিসা-টিকিট থাকলেও ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে বিদেশ যাওয়া যায় না।

ভিজিট ভিসার যাত্রীদের নিয়ে রমরমা বাণিজ্য চললেও তা যেন দেখার কেউ নেই। সমপ্রতি দেশের বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবি জানিয়ে দুবাই কনসাল জেনারেলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে দুবাইয়ে প্রবাসী ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন।

দুবাই প্রবাসী নাসিম উদ্দিন আকাশ বলেন, করোনার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। ভিজিট ভিসায় এসে যোগ্যতা অনুযায়ী শ্রমিকের ভিসা লাগানোর সুযোগ আছে। কিন্তু বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের কারণে এ সুযোগ হাতছাড়া হতে চলেছে। এ বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন।

মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীরা বলছেন, বিমানবন্দরের কিছু অসাধু কর্মচারী বৈধ ভিজিট ভিসাসহ যাবতীয় ট্রাভেল ডকুমেন্ট থাকা সত্ত্বেও ভিজিট ভিসাধারীদের আসতে বাধা দিচ্ছে। তারা কেবল ‘কন্ট্রাক্ট বাণিজ্যে’র মাধ্যমে ভিজিট ভিসাধারীদেরই আসতে দিচ্ছে। যারা ‘কন্ট্রাক্ট’ করছে না, তাদের আটকে দিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিমান ভাড়ায় যেখানে আমিরাতে আসতে পারতেন, এখন তাদের দেড় লাখ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায় তথাকথিত ‘চুক্তি’ করতে হচ্ছে। একশ্রেণির অসাধু এজেন্সি, দালাল চক্র ও বিমানবন্দরের কিছু কর্মচারী মিলে ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট’ নামে ভিজিট ভিসাধারীদের ইউএই প্রবেশের ব্যবস্থা করছে। এজন্য অনেক সময় জনপ্রতি লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়।

সম্প্রতি দুবাইতে প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আট বছরেরও বেশি সময় ধরে আমিরাতে বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ, যা আমাদের এই সম্ভাবনাময় শ্রমবাজারটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশিদের বৈধভাবে আমিরাতে আসার সুযোগ দিচ্ছে। ভিজিট ভিসায় আমিরাতে আসার পর ভিসা স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে কোম্পানির ভিসা বা পার্টনার ভিসা লাগানোর সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এয়ারপোর্টে ভিজিট ভিসাধারীদের আটকে দেওয়া হচ্ছে। কন্ট্রাক্ট বাণিজ্য ভিসা, টিকিটের মতো হয়ে গেছে। এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট তৈরি করছে মানবপাচারের সুযোগ : সম্প্রতি লিবিয়া থেকে ফেরত আসে সাতটি লাশ এবং ১৪৮ বাংলাদেশি। তারা প্রত্যেকেই ইউরোপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে ভিজিট ভিসায় দুবাই গিয়েছিল। সেখানে কিছুদিন থাকার পর ইউরোপে যাওয়ার জন্য লিবিয়া যান তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভিজিট ভিসা প্রাপ্তি সহজ হওয়ার সুযোগে প্রতারণায় নামে একশ্রেণির দালাল চক্র। সাধারণ মানুষকে ইউরোপের প্রলোভন দেখিয়ে ভিজিট ভিসার মাধ্যমে ইউএইতে নেওয়া হচ্ছে। এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের কারণে এসব পাচার ঠেকানোও যাচ্ছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীরবেই প্রতিদিন আকাশপথে মানব পাচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। সাগরপথে পাচারে জড়িত স্থানীয় দালাল ও পাচারকারীরা। কিন্তু আকাশপথে পাচারে সরকারি কর্মকর্তারাও জড়িত। যাদের দায়িত্ব পাচার রোধ করা, তারাই জড়িত পাচারে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার হিসাবে, গত বছর সাগরপথে বাংলাদেশ থেকে ৬৩ হাজার মানুষ পাচার হয়েছে পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন ও ছাড়পত্র ছাড়া বিদেশে কাজের জন্য যাওয়া অবৈধ হলেও বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন ও প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের কর্মকর্তাদের সহায়তায় মানব পাচার করা হচ্ছে।

মালয়েশিয়া ও ইরাকে জনশক্তি রপ্তানি-সংশ্লিষ্টরা জানান, বৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ সংকুচিত হওয়ায় অবৈধ পাচার দিন দিন বাড়ছে। সাগরপথে পাচার রোধে নজরদারি বৃদ্ধি পাওয়ায় আকাশপথ এখন পাচারের নিরাপদ মাধ্যম। অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার রহমান বলেন, ‘পাচারের গতিপথই এমন। একটি পথ বন্ধ হলে পাচারকারীরা অন্য পথে পাচারের সুযোগ খোঁজে।’অনুসন্ধানে জানা যায়, সংঘবদ্ধ চক্র আকাশপথে পাচারে জড়িত। একটি দল সরকারি কর্মকর্তাদের সহায়তায় প্রথমে ঢাকা বিমানবন্দর পার করে দেয়। বিদেশের বিমানবন্দর থেকে আরেকটি দল পাচারকারীদের পার করে। দালালরা এ পদ্ধতির নাম দিয়েছে ‘বডি কন্ট্রাক্ট’।

এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক পলাশ বলেন, আমরা বিমানবন্দরের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখি। এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের নামে টাকা নেওয়া ব্যক্তিকেও গ্রেপ্তার করেছি। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখবো। 

সতর্ক করল ইমিগ্রেশন পুলিশ : দুবাইসহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যান্য শহরে ভিজিট বা ট্যুরিস্ট ভিসায় গমনেচ্ছু যাত্রীদের কাছ থেকে ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট’-এর নামে টিকিট বিক্রেতারা অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীদের পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইমিগ্রেশন পুলিশ ইউনিটকে বিষয়টি জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে। এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট, ইমিগ্রেশন কন্ট্রাক্ট ও এয়ারপোর্ট সাপোর্টের নামে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করলে টিকিট বিক্রেতার নাম-পরিচয় ও প্রয়োজনীয় তথ্য এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট (০১৩০৪০৫০৬০৩), হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপারসহ (০১৩২০০০৫৯০২) সংশ্লিষ্টদের জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে এতে।

এর আগে বিমানবন্দরের সন্দেহভাজন যাত্রীদের অফলোড সিল দেওয়া ও এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে পরে সেই সিল মুছে দেওয়ার অভিযোগ ছিল ইমিগ্রেশন পুলিশের বিরুদ্ধে। ইমিগ্রেশন পুলিশ ইউনিট তাদের সতর্কবার্তায় এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্টের নামে কেউ অর্থ চাইলে ফোন দিয়ে জানাতে অনুরোধ করেছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads