• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

দ্বিগুণ দামে কিনছে যন্ত্রপাতি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৯ মার্চ ২০২২

বিভিন্ন হাসপাতালের জন্য দ্বিগুণ দামে যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বিরুদ্ধে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একটি যৌথ সিন্ডিকেট এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ৪০৪ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও কেন্দ্রীয় ওষধাগার (সিএএমএসডি) থেকে ইজিপির মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হলেও কিছু যন্ত্রপাতির বৈশিষ্ট্য এমন কৌশলে চাওয়া হয়েছে, যাতে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ সেসব সরবরাহ করতে না পারে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা যায়, একবছর আগেই যেসব যন্ত্রপাতি যে দামে কেনা হয়েছে, চলতি বছর সেগুলোর দ্বিগুণ দাম ধরেছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরবরাহকারীদের লভ্যাংশের একটি বড় অংশ অসাধু কর্মকর্তারা পকেটে ভরে নেওয়াই এর উদ্দেশ্য। এছাড়া হাসপাতাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্টের (এইচএসএম) জন্য আগে সিএমএসডির মাধ্যমে যন্ত্রপাতি কেনা হতো। লুটপাটের লোভে এবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিজেরাই প্রায় ২০০ কোটি টাকায় অর্ধেক যন্ত্রপাতি কিনছে। বাকি অর্ধেক কিনবে সিএমএসডি।

জানা গেছে, সাধারণত হাসপাতাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত হাইটেক যন্ত্রপাতি আগে সিএমএসডির মাধ্যমে কেনা হতো। ২০২১-২২ অর্থবছরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বার্ষিক কেনাকাটার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরির পর তা দুই ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ২০৪ কোটি টাকার কেনাকাটা করবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ নিজেরাই। কেনাকাটার জন্য স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের লাইন ডিরেক্টর মাজহারুল হক তপনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ২৪টি প্যাকেজের আওতায় কেনাকাটা করার জন্য ইতোমধ্যে তিনি দরপত্র আহ্বান করেছেন। বাকি ২০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনতে দরপত্র আহ্বান করেছে সিএমএসডি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিএমএসডির এই ৪০৪ কোটি টাকার কেনাকাটা নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা খোঁজ নিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লুটপাটের আগেই অপকর্ম ঠেকাতে ইতোমধ্যে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে। শিগগিরই এগুলো প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাঁর কার্যালয়ে প্রতিবেদন আকারে পৌঁছাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিএমএসডির বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ওষধাগার যে প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনা তৈরি করেছে, সেখানে একটি মেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কেনার বাজেট ধরা হয়েছিল সাড়ে ৪ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছর (২০২১-২০২২) স্বাস্থ্য অধিদফতর সেই একই মেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কিনতে ৮ কোটি টাকা বাজেট ধরেছে। গত বছরের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় ওষধাগার ২৩৪টি আইসিইউ বেড কেনে, যেগুলোর প্রতিটির দাম ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। চলতি বছরেও ৫০টি আইসিইউ বেড কেনা হবে, তবে এবার প্রতিটির জন্য বাজেট ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এছাড়া গত বছরের তুলনায় প্রতিটি আইসিইউ ভেন্টিলেটরের ক্ষেত্রে প্রায় চার লাখ টাকা করে বাড়তি দাম ধরা হয়েছে। গত বছরের আগস্টে সিএমএসডি ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা করে পেশেন্ট মনিটর কিনেছিল, এবার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সেই একই পেশেন্ট মনিটরের দাম ধরেছে ছয় লাখ টাকা করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ গত ৯ মার্চ চারটি আলট্রাসনোগ্রাম, ফোরডি কালার ডপলার (প্যাকেজ নং এইএসএম, জিডি-২১৭৯) কিনতে দরপত্র আহ্বান করেছে। প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনায় এই যন্ত্রের বাজেট প্রতিটি ৭০ লাখ টাকা করে ধরা হয়েছে। অথচ গত বছর সিএমএসডি এই যন্ত্র ২৯ লাখ টাকা করে কিনেছিল। এসএস সায়েন্টিফিক করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই যন্ত্র সরবরাহ করেছিল।

গত বছর আনিফকো হেলথকেয়ারের মাধ্যমে ৫০ লাখ টাকা করে ইকোকার্ডিওগ্রাফি ফোরডি ডপলার কেনা হয়, এ বছর সেই যন্ত্র কেনার বাজেট ধরা হয়েছে ৭০ লাখ টাকা করে। একইভাবে গত বছর সিরিঞ্জ পাম্প কেনা হয়েছিল ৮০ হাজার টাকা করে, এ বছর তা কিনতে বাজেট ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গত বছর ইনফিউশন পাম্প কেনা হয়েছিল ৮৫ হাজার টাকা দরে, এ বছর এর বাজেট রাখা হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা করে।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে সিএমএসডি ধানমন্ডির ট্রেড হাউজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সিঙ্গেল ব্লাড ব্যাগ প্রতিটি ১২০ টাকা, ডাবল ব্লাড ব্যাগ প্রতিটি ১৮০ টাকা ও ট্রিপল ব্লাড ব্যাগ প্রতিটি ২৭৭ টাকা করে কিনেছিল। এ বছর সিঙ্গেল ব্লাড ব্যাগ ২০০ টাকা, ডাবল ব্লাড ব্যাগ ২৫০ টাকা ও ট্রিপল ব্লাড ব্যাগ ৩৫০ টাকা করে বাজেট করা হয়েছে। চলতি বছর মোট ৬ লাখ ৪২ হাজার ব্লাড ব্যাগ কেনার পরিকল্পনা করেছে সিএমএসডি।

সরকারি কেনাকাটার সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, সাধারণত প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনায় যে বাজেট ধরা হয়, তার সঙ্গে প্রাক্কলিত ব্যয়ের খুব বেশি হেরফের হয় না। আর প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনা তৈরির সময় পণ্যের বাজার যাচাই করেই বাজেট ধরা হয়। বাজার দামের সঙ্গে অল্প কিছু হেরফের হতে পারে, কিন্তু লাখ লাখ টাকা হেরফের হওয়ার কথা নয়।

পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে অভিনব কৌশল : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পছন্দের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে অভিনব কৌশল বেছে নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিএমএসডির ক্রয় কমিটি। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের লাইন ডিরেক্টর মাজহারুল ইসলাম তপন এর প্রধান। এছাড়া টেকনিক্যাল কমিটিতেও আছেন তিনি। এমনকি সিএমএসডির ক্রয় কমিটিতেও রাখা হয়েছে তাকে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কেনাকাটার জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হলেও হাইটেক কিছু যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে সেগুলোর স্পেসিফিকেশনের সবিস্তার বর্ণনা এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যাতে নির্দিষ্ট ওই প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কেউ দরপত্রে অংশ নিলেও কাজ না পায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ হাসপাতাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কিনতে দরপত্রের ১৯ নম্বর প্যাকেজে যেসব টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন বা যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে, তার সঙ্গে ফরাসি প্রতিষ্ঠান ইকোডাস-এর যন্ত্রের বিবরণের হুবহু মিল রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশে ইকোডাসের এজেন্টকে যন্ত্র সরবরাহের কাজ দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এমন করা হয়েছে, যাতে অন্য কেউ দরপত্রে অংশ নিতে না পারে। একই ধরনের আরেকটি দামি মেডিকেল যন্ত্র কেনার ক্ষেত্রে সিএমএসডির দরপত্রেও একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন বা যন্ত্রের বিস্তারিত বিবরণ তুলে দেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সিএমএসডি ব্লাড ইরেডিয়েটর (এইচএসএম-২১১৩ প্যাকেজ) কিনতে একটি দরপত্র আহ্বান করে। এতে বিদেশি প্রতিষ্ঠান রেড সোর্স এক্স-রের আরএস ৩৪০০ মডেলের ব্লাড ইরেডিয়েটরের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন তুলে দেওয়া হয়েছে। রেড সোর্সের বাংলাদেশি এজেন্ট ছাড়া অন্য কেউ যেন এটি সরবরাহ করতে না পারে সেজন্যই এই কৌশল বেছে নেওয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের লাইন ডিরেক্টর মাজহারুল হক তপনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

তবে সিএমএসডির পরিচালক মোখলেসুর রহমান সরকার বলেন, টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশনের ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি এলে পুনরায় এ বিষয়ে সাধারণত বৈঠকের মাধ্যমে পুনর্বিবেচনা করা হয়। আমরা প্রতিটি বিষয় আমলে নিয়ে কাজ করছি।

একবছরের ব্যবধানে একই যন্ত্রের বিপরীতে দ্বিগুণ বাজেট ধরা প্রসঙ্গে সিএমএসডির এই পরিচালকের ব্যাখ্যা, ‘এটা আন্তর্জাতিক বাজার দামের ওঠানামা করার কারণে হতে পারে। তবে যন্ত্রের স্পেসিফিকেশনের ওপর সেটি নির্ভর করে। সুনির্দিষ্ট করে বললে আমরা এগুলো অবশ্যই খতিয়ে দেখবো।’

মেডিকেল ইকুইপমেন্ট আমদানি বা ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একবছরের ব্যবধানে কোনোভাবেই একই যন্ত্রের দাম দ্বিগুণ হওয়ার সুযোগ নেই। প্রকিউরমেন্ট পরিকল্পনা এত বেশি মূল্য ধরে করা হয়, যাতে অনুমোদিত বাজেটের চেয়ে কম দামে কিনেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব। এতে কমিশন বাণিজ্য যেমন সহজ, তেমনি বিল অনুমোদন করাতে কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না।

মিঠু নেই, নতুন সিন্ডিকেট সক্রিয় : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একসময় মোতাজজেরুল ইসলাম মিঠু নামে একজনের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তিনি বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ভুয়া চাহিদাপত্র তৈরি করে সিএমএসডির মাধ্যমে যন্ত্রপাতি কেনাতেন। তার নিজের প্রতিষ্ঠান সেসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতো।

২০২০ সালের ৩০ মে সিএমএসডির তৎকালীন পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদউল্লাহ মিঠুর সিন্ডিকেটের কেনাকাটা নিয়ে অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিবকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন। এরপরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি নিয়ে কাজ শুরু করে রাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া সিএমএসডির পরিচালক আবু হেনা মোরশেদ জামানও কিছুটা ভূমিকা রাখেন মিঠু সিন্ডিকেট দমনে। তখন থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মিঠু সিন্ডিকেট কিছুটা পিছু হটলেও নতুনভাবে আবারো সিন্ডিকেট তৈরি করে লুটপাটের পাঁয়তারা চলছে।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, তারা ইতোমেধ্য জানতে পেরেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন বিভিন্ন কেনাকাটার বিষয়ে একজন কর্মকর্তা সরবরাহকারীদের সঙ্গে মৌখিকভাবে ১০-১৫ শতাংশ হারে ঘুষ নেওয়ার চুক্তি করেছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যে কাজ পাওয়ার জন্য অর্থও দিয়েছেন। ওই কর্মকর্তা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে এসব করছেন বলে তারা জানতে পারছেন। তার বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে দুদক সূত্র জানিয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির উৎসগুলো চিহ্নিত করে এর আগেও তারা বেশকিছু সুপারিশ পাঠিয়েছিলেন। সবশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদনেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেনাকাটায় দুর্নীতির উৎসগুলো চিহ্নিত করে সেসব প্রতিরোধে সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে তারা এই খাতে দুর্নীতির বিষয়ে তীক্ষ্ন নজরদারি করছেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads