• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

সার্ভার সমস্যায় জিম্মি গ্রাহক

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ২১ এপ্রিল ২০২২

মো. আনোয়ার হোসেন। পুরানা পল্টনের বাসিন্দা। গতকাল বুধবার ৩৩ তোপখানা রোডস্থ জনতা ব্যাংকে গিয়েও জমা দিতে পারেননি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (টিজিটিডিসিএল) বিল। ব্যাংকে থেকে জানানো হয়, তিতাসের সার্ভারে ত্রুটির কারণে বিল নেওয়া যাচ্ছে না। তিনি ব্যাংকের কর্তব্যরত ব্যাংক কর্মকর্তাকে বলেন, যথাসময়ে বিল দিতে না পারলে জরিমানা দিতে হবে। এর দায় কে নেবে। এর সঠিক উত্তর দিতে পারেননি ব্যাংক কর্মকর্তা।

সরকারি কর্মকর্তা  মো. আশরাফ। তিনি শাজাহানপুরের বাসিন্দা। মতিঝিল অফিসের হাজিরা দিয়েই তিনি বায়তুল মোকাররম এলাকায় সোনালী ব্যাংক শাখায় তিতাসের বিল জমা দিতে যান। তিনিও বিল জমা দিতে পারেননি। তাকেও ব্যাংক থেকে জানানো হয় নেটওয়ার্কে সমস্যা। গত ৩ দিন ধরে তিতাসের নেটওয়ার্কে জটিলতা দেখা দিয়েছে। সে কারণেই মো. আশরাফের বিলটি নেওয়া সম্ভব হয়নি। ব্যাংকটির এ শাখা থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পারভিন আক্তার, জয়নাল আবেদিন, সুধির হাওলাদার, জুয়েলারি ব্যবসায়ী শেখর হাওলাদারসহ আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্পকারখানাসহ বিভিন্ন তিতাস গ্যাসের গ্রাহকরা ক্ষুব্ধ হয়ে চলে যান। সবার একই অভিযোগ, এই বিল পরিশোধ করতে হলে পরে জরিমানা দিতে হবে। শুধু আনোয়ার হোসেন, মো. আফরাফ, পারভিন আক্তার, জয়নাল আবেদিনই নয়, পুরো রাজধানীর লাখ লাখ গ্রাহক তিতাসের বিল ব্যাংকে জমা দিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। জানা গেছে, গত ১৮ এপ্রিল সকাল থেকে তিতাসের বিল জমা নেওয়ার সার্ভারে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিতাস সার্ভার সমস্যা সমাধান করতে পারেনি। এ ভাবে চলতে থাকলে ২৮ লাখ গ্রাহককে দিতে হবে কয়েক কোটি টাকা জরিমানা। বিশেষজ্ঞরা দ্রুত সার্ভার সমস্যা সমাধান এবং জরিমানার অর্থ মওকুফের জন্য সংশ্লিস্টদের প্রতি আহ্বান জানান।

মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিউ রোডে অবস্থিত জনতা ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এ কে এম মনির চৌধুরী জানান, তিতাসের সার্ভারে আপগ্রেডেশনের কাজ চলছে। এ কারণে বিল জমা নেওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার গ্রাহক ব্যাংকে এসে ক্ষুব্ধ হয়ে হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। গ্রাহক হয়রানির দায় মূলত ব্যাংকের নয়। তার মতে, এই সমস্যা আগেই মোবাইল ফোনে মেসেজ বা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গ্রাহকদের জানানো উচিত ছিল।  

তোপখানা রোডে অবস্থিত জনতা ব্যাংকের অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার পঙ্কজ কুমার রায় বলেন, এটা দুঃখজনক ঘটনা। তিতাসের সার্ভারে ত্রুটির কারণের তিতাস গ্রাহকরা হয়রানির স্বীকার হবেন এটা মেনে নেওয়া যায় না। বিভিন্ন গ্রাহক বিল জমা দিতে না পেরে আমার কাছে আসছেন, তখন তাদের আমি কি করতে পারি বা কাকে এর জন্য দায়ি করবো এটা বলতে পারি না। তিনি বিষয়টি দ্রুত সমাধান করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানান।

এ বিষয়ে তিতাস গ্যাসের উপমহাব্যবস্থাপক এএইচএম মাছউদুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি কিছু না বলে এড়িয়ে যান। তিনি আইসিডি ও অর্থ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু আইসিডি ও অর্থ বিভাগের কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে চান না।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তিতাসের সার্ভারে ঢুকে অভিনব জালিয়াতির অভিযোগে তিতাসের ৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। অবৈধ গ্যাস সংযোগ প্রদানের পর রাতের আঁধারে কেন্দ্রীয় সার্ভারে ঢুকে সেগুলোর বৈধতা দেওয়া হয়। এভাবে এক রাতেই এক হাজার ২৪৭টি অবৈধ সংযোগ বৈধ করা হয়। এই অভিনব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মেলায় আট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। কোম্পানির বাড্ডা জোনের এ ঘটনায়  ওইসময়  রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়। অভিযুক্তদের সাময়িকভাবে বরখাস্তও করা হয়েছিল। তার পরেও তিতাস গ্যাস কোম্পানির অনিয়ম দুর্নীতি দূর হয়নি।

এদিকে, নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে অবৈধ সংযোগের রমরমা বাণিজ্য চলছে। এ কাজের সঙ্গে সিবিএ নেতা, কম্পিউটার অপারেটরসহ কোম্পানির অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত। কয়েক মাস আগে ১৭৩ বাড়িতে নতুন এক হাজার ২৪৭টি চুলার তথ্য তিতাসের সেন্ট্রাল সার্ভারে যুক্ত করা হয়। বিষয়টি সমপ্রতি সামনে আসায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে তিতাস। চার সদস্যের এ তদন্ত কমিটি এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাড্ডা জোনের কয়েক কর্মকর্তার যোগসাজশ ও অবহেলা খুঁজে পায়। অনুসন্ধান চলাকালে তদন্ত কমিটি দেখতে পায়, জোনাল অফিসের সিসি ক্যামেরা দীর্ঘদিন ধরে অচল থাকলেও তা সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তিতাস কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এ অপকর্মে আটটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জড়িত বলে কমিটির প্রতিবেদনে জানানো হয়। এই আট প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত ও তাদের তিতাস কার্যালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারির সুপারিশ করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। এর পর বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চললেও সংঘটিত নারায়ণগঞ্জে মসজিদে দুর্ঘটনার পর সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে তিতাস। বাড্ডা অফিসের সাময়িক বরখাস্ত আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।

তিতাসের এক কর্মকর্তা জানান, ২০১০ সালের ১৩ জুলাই আবাসিকে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ৭ মে থেকে শর্তসাপেক্ষে বাসাবাড়িতে নতুন সংযোগ দেওয়া শুরু হলেও এক বছরের মাথায় তা ফের বন্ধ করা হয়। এখন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি। কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও প্রতিবছর তিতাসের বার্ষিক প্রতিবেদনে সংযোগ বৃদ্ধির তথ্য উঠে আসে। চলতি বছরের শুরুর এ বিষয়ে তদন্তে নামে তিতাস। তিতাসের তদন্তে দেখা যায়, সাত লাখ সংযোগ বিভিন্ন সময়ে সার্ভারে এন্ট্রি করে বৈধ করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক তদন্তে এক হাজার ২৪৭টি সংযোগের বৈধতার সঙ্গে জড়িত থাকায় আটজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে মামলায় বলা হয়েছে, সাত লাখ অবৈধ সংযোগ একই প্রক্রিয়াতে বৈধ করা হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, গ্যাস বিতরণের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় এই কোম্পানিটি এমন সব দুর্নীতি সামনে এসেছে যা পুরোপুরি নতুন ও কল্পনাতীত। বৈধ সংযোগ বন্ধ, তখন সংযোগ দেওয়া হয়েছে, আবার সেসব গ্রাহকের আস্থা সৃষ্টি করার জন্য কাগজপত্র তুলে দেওয়া হয় তাদের হাতে। যথারীতি সেসব গ্রাহক বিলও জমা করেন। ২০১২ সালে এ রকম পে-স্লিপের মাধ্যমে ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকা জমা পড়ে। তিতাসের আবাসিক গ্রাহকেরা যেসব ব্যাংকে প্রতি মাসে গ্যাসের বিল জমা দেন, সেই ব্যাংকগুলো থেকে ওই বাড়তি টাকার হিসাব কোম্পানির কেন্দ্রীয় হিসাব বিভাগে আসে। কিন্তু এই টাকা তিতাসের হিসাবে জমা হচ্ছে না ( পোস্টিং না হওয়া) তাই বেকায়দায় পড়ে তিতাস। আর তখনেই বিষয়টি সামনে চলে এলে তখন বিষয়টি নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যকর সৃষ্টি হয়।

সমপ্রতি আরেকটি হাস্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছেন বিতর্কিত এই কোম্পানিটি। বাহবা নেওয়ার জন্য বিশাল এলাকাজুড়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার খবর বিজ্ঞপ্তি পাঠায় মিডিয়াতে। গত বছর ২৫ মে পাঠানো সেই বিজ্ঞপ্তিতে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার ইমামপুর বাঘাবন্দি (বাঘাইয়াকান্দি) গ্রামের নাম লেখা হয়। কিন্তু গ্রামবাসী দাবি করেছেন তাদের এলাকার কখনো লাইন ছিল না। তাহলে কাটলো কিভাবে। এই ঘটনায় বেশ হাস্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে। মিডিয়া কর্মীরা বলেছেন, তিতাস মাঝে মধ্যেই এমন বাহবা নেওয়ার জন্য উচ্ছেদ অভিযানের প্রেস রিলিজ পাঠায়। এতোদিনও হয়তো অনেক কিছু বাগাড়ম্বর করেছে, এতোদিন কেউ খোঁজ নেয়নি বলে ধরা পড়েনি।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১২ সালে আবার সংযোগ চালু হলেও ২০১৩ সালের শুরুতেই তা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সরকারের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই প্রতিবছর সংযোগের তথ্য উঠে এসেছে তাদেরই বার্ষিক প্রতিবেদনে। অনেকে মনে করেন, তিতাসের প্রতিবেদনে সামন্যই উঠে এসেছে। এর চেয়ে ঢের বেশি রয়েছে অবৈধ সংযোগ, যেগুলো ঘুষের বিনিময়ে সংযোগ দেওয়া হয়েছে, আর প্রতিমাসেই বিল আদায় করা হয়। ২০১৮ সালের প্রথম দিকে তিতাসের বোর্ড সভা সাত লাখ গ্রাহকের সংযোগ বৈধ করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত তিতাসের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক ছিল ২৮ লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯, যা ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ছিল ১৮ লাখ ৮০ হাজার ৩৫৩। অর্থাৎ চার বছরে সংযোগ বেড়েছে ৯ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬টি।

১৯৬৪ সালের ২১ নভেম্বর থেকে তিতাসের কার্যক্রম শুরু করে। এরপর ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুরে গ্যাস সরবরাহ করে আসছে। আবাসিক গ্রাহক রয়েছে ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৮৪৮ জন, বাণিজ্যিক গ্রাহক সংখ্যা ১২ হাজার ৭৫টি, সিএনজি ৩৯৬টি, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১ হাজার ৭০১টি, শিল্প গ্রাহক রয়েছে ৫ হাজার ৩১৩ এবং ৩টি সার কারখানা ও ৪৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads