• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
ব্যয় সংকোচনের চেষ্টায় সরকার

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

ব্যয় সংকোচনের চেষ্টায় সরকার

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২১ মে ২০২২

করোনো পরবতী অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একই সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে লাগামহীনভাবে। বাংলাদেশে অল্প সময়ের ব্যবধানে ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো বেড়েছে চাল, ডাল, আটা, ময়দা, দুধসহ প্রায় প্রতিটি ভোগ্যপণ্যের দাম। আবার জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে শুধু আমদানিনির্ভরই নয়, দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়ছে। ডলারের দামও বাড়ছে দফায় দফায়। সর্বশেষ গত রোববার এক লাফে ডলারের দাম ৮০ পয়সা বাড়ায় সবার মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার ব্যয় সংকোচন নীতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গত কয়েকদিন ধরেই ব্যয় সংকোচন নীতি নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন বা পে-স্কেল ঘোষণা না করা, ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা, বিলাসবহুল  পণ্যের আমদানির গতি কমাতে কৌশল নির্ধারণ, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবাহ ঠিক রাখতে করণীয় নির্ধারণ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

ইতোমধ্যে ব্যয় কমাতে অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর আপাতত বন্ধ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা ও গত বৃহস্পতিবার বিচারকদেরও বিদেশ ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা এসেছে। শুধু সরকারি পর্যায়েই নয়, বেসরকারি পর্যায়েও ব্যয় কমানোর কৌশল ঠিক করা হচ্ছে। এছাড়া ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এমপি ও বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদেরও মিতব্যয়ী ও সাশ্রয়ী হওয়া এবং জনগণের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা।

অতি প্রয়োজনীয় খাত ছাড়া রিজার্ভ থেকে ডলারের জোগান বন্ধ করা হয়েছে। বেসরকারি খাতেও বৈদেশিক মুদ্রাছাড় কম করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ পর্যাপ্ত ডলার না থাকায় ব্যাংকগুলো ব্যক্তি খাতে যেমন ডলার দিতে পারছে না, তেমনি নতুন এলসি খোলাও কমিয়ে দিয়েছে। আগের এলসির দেনাও শোধ করছে চড়া দামে ডলার কিনে।

করোনার কারণে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা ও খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করে আসছে গত বছরের শুরু থেকে। এখন নতুন করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দীর্ঘ রূপ নেওয়ায় মন্দা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার কারণে আগামী মাসগুলোতে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। গত বুধবার নিউইয়র্কে দেওয়া ভাষণে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, যুদ্ধের কারণে দামের ঊর্ধ্বগতি দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে।

বাংলাদেশের মতো ছোট দেশই নয় বড় দেশগুলোও বৈশ্বিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির চাপে ব্যয় সংকোচন নীতিতে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে জ্বালানি ও খাদ্যের দাম সারা বিশ্বেই হু হু করে বাড়ছে। এর জেরে এখন যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের মানুষের এখন উপোস করতে হচ্ছে। দ্য ফুড ফাউন্ডেশনের এক জরিপে উঠে এসেছে যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশের মানুষও নাকি এখন এক বেলা উপোস করছেন বা খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ৩০ বছরের মধ্যে তা এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের পূর্বাভাস, মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশে উঠতে পারে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে যুক্তরাজ্যের অনেক মানুষ এখন হিমায়িত খাদ্যের দিকে ঝুঁকছেন। কারণ, খাবার রান্না করতে গেলে গ্যাস বা বিদ্যুতের বিল বেড়ে যাচ্ছে।

ডলারের সাপেক্ষে তলানিতে ঠেকেছে পাকিস্তানি রুপির দর। এর আগে কখনো পাকিস্তানের মুদ্রার দর এত নিচে কখনো নামেনি। ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মানও রেকর্ড সর্বনিন্মে নেমে এসেছে।

এরকম অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দু-তিন দিনের মধ্যে জানানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কীভাবে ব্যয় সংকোচন করা যায় সে জন্য তাদের একটা কৌশল ঠিক করতে বলা হয়েছে। এরপর এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা দেওয়া হবে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান প্রকল্পগুলো সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা করা হচ্ছে। অগ্রাধিকার কয়েকটি প্রকল্প ছাড়া বাকি কাজ বন্ধ রাখা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সরকার ব্যয় কমানো এবং সম্পদ সংরক্ষণের খাতগুলো দেখছে। আর ব্যয় কমানোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে আমদানিনির্ভর বড় এবং কম প্রয়োজনীয় প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখা। এ ছাড়া আমদানিনির্ভর প্রয়োজনীয় প্রকল্পের কাজের গতি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, গত বৃহস্পতিবকার মন্ত্রিসভার বৈঠকে চলমান বিশ্ব অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলায় অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে একসঙ্গে বসে করণীয় ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী দু-তিনদিনের মধ্যে বসে বৈঠকের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। কমার্স অ্যান্ড অর্থ মন্ত্রণালয়কে কতগুলো নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, পর্যাপ্ত এবং কমিপ্রহেনসিভ ব্যবস্থা নিয়ে সবার কাছে তুলে ধরার জন্য। প্লাস ডলারের যে ক্রাইসিস হচ্ছে এটা কিভাবে সলভ করা যায় এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বসে দু-তিনদিনের মধ্যে প্রেসের সামনে বসার জন্য। এছাড়া আমদানি করা পণ্যে ট্যাক্স আরোপের বিষয়ে ব্যাপক কাট-ছাঁটের ইঙ্গিত দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সচিব বলেন, সারা বিশ্বেও মতো আমাদেরও হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরও মানবিক করতে হবে।

এদিকে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে দামি গাড়ি, বিলাসপণ্য ও নিত্যব্যবহার্য ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব পণ্য আমদানির ঋণপত্র খোলার সময় এখন ৭৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম জমা দিতে হবে। এ ছাড়া শিশুখাদ্য, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, ওষুধ, কৃষি ও রপ্তানিমুখী শিল্প ছাড়া সব আমদানিতে ৫০ শতাংশ অর্থ আগে দিতে হবে। আগে ২৫ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েই পণ্য আমদানি করা যেত।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সময় যখন কঠিন, তখন সিদ্ধান্তও নিতে হয় কঠিন। স্বাভাবিকভাবে আমরা বিলাসপণ্য দুই মাস পর কিনতে পারি। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বিলাসী পণ্য কিছুদিনের জন্য নয়। তবে নিত্যপণ্যে কোনো হাত দেওয়া হবে না বলে জানান তিনি।

সরকারের এ ব্যয় সংকোচন নীতির উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, আরো আগে এটা করা গেলে বেশি ভালো হতো। অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, সরকারের ব্যয় কমানোর এ ঘোষণা অবশ্যই ইতিবাচক। আর ডলারের দাম এখন যা বেড়েছে তাতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কেউ যেন এ সুযোগে ডলার মজুত না করে সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, শুধু সরকারি কর্মকর্তাদেরই নয়, বিদেশ সফরের লাগাম টেনে ধরতে হবে সব ক্ষেত্রে। বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত বাজেটেও ব্যয় সংকোচনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা এবং অপ্রয়োজনীয় ভর্তুকি বন্ধ করতে হবে। খাদ্য আমদানির বিকল্প নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করতে হবে। 

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমাদের অবশ্যই আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। উন্নয়ন ব্যয়ে সাশ্রয়ী হতে হবে। রাজস্ব আদায়ের চিরাচরিত দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এমনিতেই কোভিডে বৈদেশিক ঋণনির্ভর মেগা প্রকল্পের কারণে সরকারের সুদ পরিশোধের দায় বেড়েছে, এটা আরো বাড়বে। রাজস্ব আয়ের একটা বড় ও ক্রমবর্ধমান অংশ চলে যাচ্ছে দেশি ও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি অবশ্যই দরকার বলে মনে করেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads