• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
ভরা মৌসুমে দাম বাড়ছে ধানের

ফাইল ছবি

জাতীয়

ভরা মৌসুমে দাম বাড়ছে ধানের

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ৩১ মে ২০২২

ভরা মৌসুমেও হু হু করে বাড়ছে ধানের দাম। সেই সঙ্গে বাড়ছে চালের দামও। কয়েকটি সিন্ডিকেটের ব্যাপক মজুতদারির কারণেই বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভোজ্যতেলের মতো ধানের বাজারও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছে তারা। তাই মজুতদারি ঠেকাতে সরকারকে বাজার মনিটরিংয়ে জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন ও মিল মালিকরা। এদিকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্টদের অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি আর ডলারের দাম বৃদ্ধির আলোচনায় এবার যুক্ত হয়েছে ধানের বাজার। এই সুযোগে গত এক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে ৫০ কেজির বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ব্যাপক মজুতদারির কারণেই মূলত ভরা মৌসুমে ধানের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। চাল ব্যবসায় যুক্ত বড় বড় সিন্ডিকেট বিপুল পরিমাণ ধান ও চাল কেনা শুরু করায় অস্থির হয়ে উঠছে বাজার। পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি মজুতদাররাও এই পথে হাঁটছে। তৎপর হয়ে উঠেছে মিল মালিকরাও।

মূলত বাজারে চাল সরবরাহকারী বড় কোম্পানিগুলো ধান কিনে মজুত করছে, যা আগে হতো না। তারা আগে মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনতো ও এতটা আগ্রাসী ছিল না। এখন ১২-১৪টি বড় কোম্পানি একসঙ্গে এক বছরের চাল কিনে মজুত করতে চাচ্ছে। ফলে গত সপ্তাহ থেকে দাম দফায় দফায় বাড়ছে। তারা চাইছে, ভোজ্যতেলের মতো চালের বাজারও নিয়ন্ত্রণে নিতে। এক বছরের মজুত নিশ্চিত করতে পারলে নিজেদের মতো করে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দামে কারসাজি করতে পারবে। তখন অভিযান চালিয়েও চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এখন যেমন কয়েক হাজার আড়তদারের মধ্যে দামের প্রতিযোগিতা চলছে, তখন গুটিকয়েক কোম্পানির হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। ফলে ভেঙে যাবে প্রচলিত চাল বিক্রির রীতি।

সূত্র আরো জানায়, দীর্ঘদিন ধরে বড় বড় কয়েকটি কোম্পানি সুগন্ধিসহ কিছু চিকন চাল কিনে ছোট আকারে প্যাকেট করে বাজারজাত করতো। আর সাধারণ মিলাররা চিকন চাল ৫০ কেজির বস্তায় বিক্রি করে। কিন্তুবড় কয়েকটি কোম্পানি দাম বাড়িয়ে দিয়ে একই চাল ১, ৫, ১০, ১৫, ২০, ২৫ কেজির সুবিধাজনক প্যাকেট তৈরি করে বাজারে বিক্রি করতো। তারাই এখন প্রতিযোগিতা করে মিল থেকে চাল কিনতে শুরু করেছে। ফলে বাজারে চাপ পড়ছে। একজন আড়তদার মজুত করলে ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে তৎক্ষণাৎ ভ্রাম্যমাণ আদালত দিয়ে অভিযান চালিয়ে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু বড় কোম্পানি কারখানায় সহজে অভিযান চালানো যায় না। ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রেই তা দেখা গেছে। ফলে সরকারকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারি সিদ্ধান্তই বড় কোম্পানির ওই আগ্রাসী ভাব দমাতে পারে।

গত রোববার পৃথক দুটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও করপোরেট হাউসগুলোর ধান মজুদের কথা উল্লেখ করেন। সুনামগঞ্জে এক মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, সামনে নির্বাচন, তাই  সরকার চালের দাম বাড়তে দেবে না। কিন্তু বাজারে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। একই দিনে সচিবালয়ে অনলাইন এক মতবিনিময় সভায় যুক্ত হয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ধান কিনে মজুত করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে। বিভিন্ন করপোরেট হাউস ধান-চালের ব্যবসা শুরু করেছে। তারা বাজার থেকে ধান কিনে মজুত করছে এবং প্যাকেটজাত করছে। প্যাকেটজাত চাল বেশি দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

এ সময় ধান চালের ব্যবসায় সম্পৃক্ত করপোরেট হাউসগুলোর সঙ্গে দ্রুততম সময়ে বৈঠক করতে খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন মন্ত্রী। মিলমালিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বোরো তোলার এই ভরা মৌসুমে মিলাররা বাজার থেকে ধান কিনলেও চাল উৎপাদনে যাচ্ছেন না। এখন বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে, তা গত বছরের। তাহলে চলতি মৌসুমের নতুন ধান যাচ্ছে কোথায়? তিনি বলেন, সবাই প্রতিযোগিতা করে ধান কিনছেন, ভাবছেন ধান কিনলেই লাভ। এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভালো পরিণতি আনবে না বলে সতর্কও করেন তিনি। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এ অবস্থা চলতে দেওয়া হবে না। কে কত পরিমাণ ধান কিনছেন এবং কে কত পরিমাণ চাল ক্র্যাশিং করে বাজারে ছাড়ছেন তা খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের রিপোর্ট আকারে প্রেরণ করতে হবে।

জানা যায়, দেশে এখন চলছে বোরো ধানের ভরা মৌসুম চলছে। প্রতিবছর এই সময় চালের দাম কমতির দিকে থাকে। কিন্তু এবার চিত্র উল্টো, যা দেখে বিস্মিত বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবদুর রশিদও। তিনি বলেন, আমার জীবনে এই ভরা মৌসুমে এভাবে মিনিকেট চালের দাম বাড়তে দেখিনি। দাম বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বড় ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টরা (শিল্পপতিরা) হয়তো ধান ও চাল মজুত রেখেছে। এ ক্ষেত্রে তদারকি বাড়ানো দরকার।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার হাওরে আগাম পানি এসে কিছু ধান নষ্ট হয়েছে। বিশ্ববাজারে চালের দামও কিছুটা বাড়তি। তাই বলে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। মূলত ধান ও চাল কিনে রেখে ভবিষ্যতে ভালো মুনাফা করার সুযোগ খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা। মজুতদাররা বাজারে না ছেড়ে চাল ধরে রাখছেন বলেই দাম বাড়ছে।

চালকল মালিকদের দাবি, ধানের দাম বাড়ার কারণে চাল উৎপাদনের খরচও বেড়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রকারভেদে প্রতি মণ ধানের দাম ৮০ থেকে ২০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। নওগাঁর অন্যতম বড় ধানের বাজার পত্নীতলা উপজেলার মধুইল বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি মণ (৪০ কেজি) জিরা ধান মানভেদে (শুকনা ও ভেজা ধান) বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৩৪০ থেকে ১ হাজার ৩৬০ টাকায়।

নওগাঁর মধুইল বাজারের ধানের আড়তদার আমিনুল ইসলাম বলেন, এবার পাকা ধান কাটার আগমুহূর্তে প্রচুর বৃষ্টির কারণে খেতেই ধানের একটা অংশ নষ্ট হয়েছে। চাল ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশি ধান কেনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ফলে প্রতিদিনই ধানের দাম বাড়ছে।

জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, চালের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ ধানের দাম বেশি। বৈরি আবহাওয়ার কারণে নওগাঁসহ উত্তরাঞ্চলে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ধানের উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কার কারণে, বাজারে ব্যবসায়ীদের ধান কেনার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বেশি দামে ধান কেনার পর চাল উৎপাদনের পর খরচ সমন্বয় করতে গিয়ে চালের দাম বাড়াতে হচ্ছে।

নওগাঁ ধান ও চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য সংকট তৈরি হবে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার হয়েছে। যার কারণে অনেকেই ভাবছেন দেশে চালের ক্রাইসিস তৈরি হবে। তাই অনেকেই অবৈধ মজুত করছেন। এ ধরনের অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ধান উৎপাদন মৌসুমে বাজারে চালের দামে অস্থিরতা থাকার কথা নয়। মজুতদারি ঠেকাতে সরকারকে বাজার মনিটরিংয়ে জোর দিতে হবে। বিশ্ববাজারের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যাতে চালের বাজার অস্থির করতে না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এদিকে ভরা মৌসুমে ধান-চালের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি নিয়ে অ্যাকশনে যেতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কেউ অবৈধভাবে চাল মজুত করলে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ নির্দেশ দেন তিনি। বৈঠক শেষে বিকেল সাড়ে ৩টায় সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ তথ্য জানান।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, চাল ও তেল নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। মার্কেট সার্ভে করে দ্রুত অ্যাকশনে যেতে বলা হয়েছে। তেলের মতো চাল ইস্যুতেও অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মজুত করলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বাণিজ্য, খাদ্য এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads