• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
লোকসান তবুও বাড়ছে ভর্তুকি!

রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি ১২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসান দিয়েছে টিসিবি

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

লোকসান তবুও বাড়ছে ভর্তুকি!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৫ জুন ২০২২

দুর্নীতি ও অদক্ষতাসহ নানা কারণে লোকসানের ভারে ডুবতে বসেছে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। তারপরও প্রতি বছর জাতীয় বাজেট থেকে এসব প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকে ওই সব প্রতিষ্ঠানের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনাদায়ী রয়েছে।

গত অর্থবছরে সরকারি ৪৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২টিতে নিট লোকসানের হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। পাটকল বন্ধ থাকায় এগুলোতে ভর্তুকি কমলেও চলতি অর্থবছরে (২০২১-২২) অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তুকি বেড়েছে। আর আগামী অর্থ বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য ভর্তুকি চলতি অর্থবছরের পরিমাণ থেকে দ্বিগুণ বাড়বে বলে সংশ্লিস্ট সূত্র জানায়।

লোকসান করলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থায়ন এবং বছরের পর বছর লোকসানি সংস্থাগুলোকে ভর্তুকি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়। পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা না করা, ব্যবস্থাপনায় অযোগ্যদের স্থান পাওয়াসহ নানা কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত লোকসান দিয়ে আসছে। হাল আমলে এসব লোকসানের পূর্ণাঙ্গ তথ্যও প্রকাশ করা হচ্ছে না।

অর্থ বিভাগের তথ্য সূত্র জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লোকসানে ছিল আটটি প্রতিষ্ঠান। এই তালিকা পরের বছরগুলোতে দীর্ঘায়িত হয়েছে। গত অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত লোকসানি এই ১২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসান দিয়েছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এক বছরের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান বেড়েছে পাঁচ গুণের বেশি।

এর মধ্যে আসন্ন ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে, সরকারকে আবারো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর জন্য ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে। সূত্র মতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ ভর্তুকির প্রাক্কলিত আকার হবে ২২ হাজার ৭১৬ দশমিক ১৩ কোটি টাকা। অর্থবছর ২০২১-২২ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১০ হাজার ৫৩৫ দশমিক ৭৪ কোটি টাকা এবং ১০ হাজার ৫১১ কোটি টাকা।

এদিকে সম্প্রতি কয়েক অর্থবছরে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) লোকসান বেড়েছে পাঁচ গুণেরও বেশি। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের হিসাবে টিসিবি সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৮৬ কোটি টাকা। তবে তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংস্থাটি ৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা লাভ করেছিল। করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কিনে তা টিসিবির মাধ্যমে কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এ বছরও এই কার্যক্রম আরো বাড়ানো হয়েছে। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানটির লোকসান বাড়ছে। তাই চলতি অর্থবছরে এ লোকসান আরো বাড়বে।

গত অর্থবছরে শীর্ষ লোকসানি সংস্থার দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। গত অর্থবছর এ সংস্থাটি লোকসান গুনেছে ৯৭১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছর সংস্থার লোকসান ছিল ৯২৯ কোটি ৯ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান দিয়েছিল ৭০২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। লোকসানে থাকা তৃতীয় স্থানে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। গত অর্থবছরে সংস্থাটি ৬৭৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা নিট লোকসান করেছে। তবে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে কমেছে। ওই অর্থবছরে বিসিআইসি লোকসান করেছিল ৭০২ কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে লোকসান করেছিল ৫৭৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।

সরকারি সব কটি পাটকল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) গত অর্থবছরের তুলনায় নিট লোকসানের পরিমাণ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বিজেএমসির নিট লোকসান হয়েছে ৩৮০ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছরে সংস্থাটি লোকসান দিয়েছিল ৭৭৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৬০৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বিটিএমসির ২৫টি পাটকলের মধ্যে ২৪টি বন্ধ রয়েছে এবং একটি ভাড়ায় চলছে। বন্ধ ২৪টির মধ্যে দুটিতে টেক্সটাইল পল্লী স্থাপন এবং দুটি পিপিপিতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা যায়। ৎ

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) গত অর্থবছরে ১২৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি তিন কোটি ৯৩ লাখ টাকা লাভ করেছিল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি) গত অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে ৯২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। তার আগের অর্থবছরে সংস্থাটি ১২৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা লোকসান গুনেছিল। সে হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান কিছুটা কমেছে। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান ছিল ১০৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) ৮১ কোটি ৬ লাখ টাকা, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (এফডিসি) ২০ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ বস্ত্র শিল্প করপোরেশন (বিটিএমসি) ১৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিএসসিআইসি) ১১ কোটি ১৯ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, এসব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে তহবিলের প্রয়োজন প্রতি বছর বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘমেয়াদি ঋণও নিচ্ছে। ফলে উভয় কারণই সরকারকে মূলধন ও ভর্তুকি বাড়াতে বাধ্য করে। গত পাঁচটি অর্থবছরে (২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত), এই সংস্থাগুলোর জন্য ভর্তুকি বেড়েছে ২৩ হাজার ৬১৫ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। শুধুমাত্র অর্থবছর ’২১-এ ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল ১১ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা।

অন্যদিকে গত অর্থবছরে ৪৯টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থার নিট মুনাফা ছিল ১৫ হাজার ১৫৯ দশমিক ৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে নয়টি করপোরেশন মোট ২ হাজার ৪৫৪ দশমিক ৪৭ কোটি টাকা লোকসান করেছে। বছরের পর বছর ভর্তুকি বাড়ানো সত্ত্বেও গত অর্থবছরেও কোনো লাভ করতে পারেনি এসব প্রতিষ্ঠান।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ প্রতিষ্ঠানগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে ভর্তুকি দেওয়া ছাড়া সরকারের আর কোনো বিকল্প নেই। যদিও তাদের মধ্যে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে। তারপরও এগুলোকে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে কারণ, এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণ জনগণের সেবা করে এবং বিপুল সংখ্যক লোকের কর্মসংস্থান বজায় রাখে।

মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিদায়ী অর্থবছরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও সারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সংশোধিত ভর্তুকির পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ২৪ হাজার ৮৭৭ দশমিক ১৮ কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার পর সরকার অনেক চাপের মধ্যে পড়েছিল। আগামী অর্থবছরে এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয়তা অনুমান করে, সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থাগুলোর জন্য ভর্তুকি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখবে।

আগের জাতীয় বাজেট অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ২৬১ দশমিক ৫৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা।

পূর্ববর্তী বাজেট এবং পরবর্তী বাজেটের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। এক দশক পর আসন্ন অর্থবছরে বাজেটের আকার ৩ দশমিক ০৪ গুণ বেড়ে দাঁড়াবে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। একই সময়ের তুলনায়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোতে ভর্তুকির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৪৯ গুণ বেড়ে যাবে।

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ডক্টর মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো কয়েক বছর ধরে ভর্তুকি ও অনুদান বাড়লেও সেগুলো রোড জোনে রয়েছে। এই সংস্থাগুলোকে জবাবদিহি করা না হলে এবং তাদের দক্ষতা উন্নত না হলে সার্বিকভাবে এর কোনো পরিবর্তন হবে না।

তিনি বলেন এই সমস্ত সংস্থাগুলোর প্রয়োজন অনুসারে বিএমআরই (ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ, পুনর্বাসন এবং সমপ্রসারণ) করা দরকার। শিল্প প্রতিষ্ঠানকেও যুক্তিযুক্ত করতে হবে। তবেই লোকসান এবং ভর্তুকি কমে যাবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), একটি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগগুলোর ওপর একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে যে, এই সংস্থাগুলোর ক্ষতি পূরণের জন্য বড় সংস্কার প্রয়োজন। তাদের মধ্যে সমস্যা সমাধান ছাড়া সামস্টিক অর্থনীতির বর্তমান দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। এভাবে ভর্তুকি অব্যাহত থাকলে, এটি কেবল সমস্যাকে আরো গভীর করবে। তাই এই সংস্থাগুলোকে প্রথমে অডিট করা দরকার এবং তারপর সংস্কারগুলো করার পরামর্শ তাদের।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্রুত সংস্কার করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানকে অনেক ঋণ দেওয়া হয়েছে। ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। তবে তার আগে একটা সুযোগ দিতে হবে। নিজেরা আয় করে নিজেরা চলতে হবে। যারা পারবে না, সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। এ বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে। ফলে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বেতনের টাকা জোগাড় করতে পারে না। এমন প্রতিষ্ঠান রেখে লাভ নেই।

তিনি আরো বলেন, আদমজী বন্ধ হয়েছে। তাতে তেমন ক্ষতি হয়নি। সেখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন হয়েছে। কয়েক লাখ লোকের নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। তাই শুধু আয়-ব্যয়ের হিসাব নজরদারি করলে চলবে না। কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। এর বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাখতে হবে। তবে পর্যায়ক্রমে বেসরকারিকরণের দিকে যেতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads