• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯
ঈদযাত্রায় সড়কে ভোগান্তি

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ঈদযাত্রায় সড়কে ভোগান্তি

  • রতন বালো
  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০২২

সারা দেশে সাড়ে ৩ হাজার পাঁচ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরার কারণে এবারের ঈদ যাত্রায় সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। বিশেষ করে চলমান বন্যায় সিলেট, হবিগঞ্জ, বাহ্মণবাড়িয়া, লালমনিরহাটসহ নতুন করে ৪৫৭ কিলোমিটার রাস্তায় চলাচল অযোগ্য হয়ে গেছে। প্রিয়জনের সাথে কোরবানির ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছেন কর্মজীবীরা। ঘরমুখো মানুষের পদচারণায় মুখরিত বাস, ট্রেন, লঞ্চ টার্মিনাল। এদিকে, পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা-বরিশাল নৌপথে যাত্রীদের ঈদযাত্রা হচ্ছে নির্বিঘ্ন। লঞ্চে চাপ নেই যাত্রীদের, এখনো মিলছে টিকিট।

গতকাল বৃহস্পতিবার সরেজমিনে বাস, রেল, লঞ্চ ও ফেরি ঘাট এলাকায় দেখা গেছে, রাজধানীর সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী ও ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন ঘরমুখো মানুষ। ভাঙাচোরা রাস্তার কারণে সড়ক পথে ধীরগতিতে চলছে বিভিন্ন পরিবহন। আর এর কারণেই তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) মহাসড়ক উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ (এইচডিএম) বিভাগের প্রতিবেদনে জানা যায়, গত বছর ৩ হাজার ৫৯১ কিলোমিটার রাস্তা বেহাল ছিল। বর্তমানে দেশের ৭৬ দশমিক ২৫ ভাগ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং জেলা সড়কের অবস্থা ভালো। আর গত বছরে প্রায় ৬৫ শতাংশ রাস্তা ভালো ছিল। ২০১৩ সালে দেশে ভালো সড়ক ছিল মাত্র ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। সাত বছরের ব্যবধানে ভালো সড়কের দৈর্ঘ্য বেড়েছে প্রায় চার গুণ। তবে ৪৫৭ কিমি রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ, চলাচলের অযোগ্য। ভাঙাচোরা রাস্তা মেরামত ও ভালো সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে আগামী পাঁচ বছরে ১৪ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা প্রয়োজন। গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত জরিপ করে ২০২২-২৩ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগের (এলজিইডি) গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প-৩ এর প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ রুহুল আমিন খান বলেন, গ্রামীণ সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ ও সংস্কারের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এই বরাদ্দ থেকে মাত্র ৩শ কোটি টাকা রেখে দেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ৭শ কোটি ব্যয় করা হয়। এ কারণে গ্রামীণ সড়ক সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। তাই আসন্ন ঈদে ঘরমুখো মানুষকে ভোগান্তি শিকার হয়ে বাড়ি যেতে হচ্ছে।

এছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম মনির হোসেন পাঠান এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছরই এইচডিএম-এর মাধ্যমে এ রকম জরিপ করা হয়। এর মাধ্যমে সড়কের বর্তমান যাচাই করা হয়। রাস্তার বর্তমান অবস্থা এখন যা আছে পরে তা নাও থাকতে পারে। এ জন্য কত বাজেট দরকার, কোন রাস্তা কোন অবস্থায় আছে দেখে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এটি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া।

সওজের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের জুন পর্যন্ত, সারা দেশে সড়ক ও মহাসড়কের দৈর্ঘ্য ২২ হাজার ৪২৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক তিন হাজার ৯৯০ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক চার হাজার ৮৯৭ কিলোমিটার এবং জেলা সড়ক ১৩ হাজার ৫৮৮ কিলোমিটার।

সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০ হাজার ৭২ কিলোমিটার সড়ক ও মহাসড়ক জরিপ করা হয়েছে। প্রায় রাস্তা জরিপ করা যায়নি উন্নয়ন কাজ চলমান থাকা এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে। জরিপে ভালো, মোটামুটি, নাজুক, খারাপ ও খুব খারপ-এ পাঁচ শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে সড়ক মহাসড়ককে। সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, যেসব রাস্তা খুব খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেগুলো আসলে যান চলাচলের উপযোগী নয়। এ হিসেবে দেশের ৪৫৭ কিলোমিটার সড়ক যান চলাচলের অনুপোযুক্ত। গত বছর এ ধরনের সড়ক ছিল ৬৯১ কিলোমিটার। তার আগের বছরে ৯৪৩ কিলোমিটার।

সারা দেশে ১০টি বিভাগে বিভক্ত সওজ। জরিপের তথ্যানুযায়ী, গোপালগঞ্জ বিভাগের সড়ক মহাসড়কের অবস্থা সবচেয়ে ভালো। এ বিভাগের মাত্র আট কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক ভাঙাচোরা। বেহালদশা চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের সড়কের। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভাঙাচোরা সড়ক মহাসড়ক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছয় হাজার ২৯৫ কোটি টাকা প্রয়োজন। চলতি বছরে চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৯০২ কোটি টাকা। তবে সরকার বরাদ্দ দেয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা।

এদিকে যানজটের কারণে সময়মতো কোনো গাড়ি কাউন্টারে পৌঁছাতে পারছে না। গুলিস্তান থেকে সায়েদাবাদ, সায়েদাবাদ থেকে চিটাগাং রোড, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে বের হতে তীব্র যানজট লক্ষ করা গেছে। সময়মতো কাউন্টারে গাড়ি না আসতে পারার কারণে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। এদিকে প্রচণ্ড গরমে শত শত গাড়ি আটকে থাকার কারণে চালক ও যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

জানা গেছে, সায়েদাবাদ থেকে চিটাগাং রোড ও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বের হতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগছে। কমলাপুর থেকে সায়েদাবাদ এসেছেন ফয়সাল নামে এক যাত্রী। তিনি জানান, কমলাপুর থেকে সায়েদাবাদ আসতে তার সময় লেগেছে এক ঘণ্টা। হেঁটে আসলেও বিশ মিনিটে আসতে পারতেন বলে জানান তিনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, হানিফ কাউন্টারে আসরাফ হোসেন নামে এক যাত্রী কাউন্টার মাস্টারের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়েছেন। সকাল ৯টায় গাড়ি ছাড়ার কথা থাকলেও এক ঘণ্টা অপেক্ষার পরেও কাউন্টারে গাড়ি আসেনি। গাড়ি কখন আসবে সেটা জানতে চান তিনি। এ সময় কাউন্টার মাস্টার রাগ করে এই যাত্রীকে বলেন, আপনি টিকিট দিয়ে টাকা ফেরত নিয়ে যান। যানজটের কারণে গাড়ি আটকে আছে এখানে তো আমাদের কিছু করার নেই।

ইমাদ এন্টারপ্রাইজে কাউন্টার মাস্টার মো. আরমান মিয়া জানান, রাস্তায় যানজট এতটাই তীব্র যে গুলিস্তান থেকে সায়েদাবাদ আমাদের গাড়ি আসতে সময় লাগছে এক থেকে দেড় ঘণ্টা। এ কারণে সময় মতো গাড়ি ছাড়তে পারছি না। যার কারণে যাত্রীদের ভিড়ও আস্তে আস্তে বাড়ছে। সায়েদাবাদ থেকে একটি গাড়ি ছাড়লে যাত্রাবাড়ী পার হতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগতেছে। সায়দাবাদ থেকে আশপাশের কোনো রাস্তা ফাঁকা নেই।

এছাড়া ঘরমুখো মানুষের পদচারণায় মুখরিত পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ঘাট। তবে ঈদ যাত্রায় দৌলতদিয়া ঘাটে কোনো দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না এবার। ফেরিতে যাত্রীবাহী যানবাহনের পাশাপাশি প্রচুর মোটরসাইকেল পার হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি মোটরসাইকেলে ঝুঁকি নিয়ে নারী ও শিশুসহ মালামাল বহন করছেন চালকরা। এ ছাড়া সময় যত বাড়ছে ততই ঘরমুখো মানুষ ও যানবাহনের চাপ বাড়ছে দৌলতদিয়া ঘাটে। তবে যাত্রীরা ভোগান্তি ছাড়াই গন্তব্যে যাচ্ছেন।

ঘাটে কোরবানির পশুবাহী ট্রাক তেমন আটকে নেই। তবে পদ্মা-যমুনা নদীতে স্রোতের কারণে ফেরি চলাচলে অসুবিধা হচ্ছে। বর্তমানে এই রুটে ১৮টি ফেরি চলাচল করছে। যাত্রীরা জানান, স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে চাপ কমেছে। ফলে ঈদে ভোগান্তি ছাড়া এবারই প্রথম তারা বাড়ি ফিরছেন। তাছাড়া বাড়তি কোনো ভাড়াও দিতে হয়নি। ফলে এবারের ঈদে আনন্দ আরো বেড়ে গেছে।

গতকাল সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল সরেজমিনে দেখা যায়, এবার ঈদে লঞ্চের কেবিনের অগ্রিম টিকিট পেতে কোনো দৌড়ঝাঁপ নেই, কারো কাছে তদবির করতে হচ্ছে না। লঞ্চের কাউন্টারে এসে চাহিদামতো টিকিট পাচ্ছেন যাত্রীরা। ঈদ উপলক্ষে এবার টিকিটের দামও বাড়েনি; বরং কেবিন ও ডেকের টিকিটের ভাড়া আগের তুলনায় কম।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে কথা হয় ভোলার যাত্রী কিরন শর্মার সঙ্গে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর সড়কপথে কম সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করছেন এই অঞ্চলের মানুষ। এতে লঞ্চে যাত্রী কমে গেছে। ফলে যাত্রী ধরে রাখতে কেবিন, ডেকের ভাড়া কমিয়ে দিয়েছেন লঞ্চ মালিকরা। তাদের কাছে যাত্রীদের কদরও বেড়েছে।

একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করা বরিশালের মো. পলাশ মিয়া বলেন, ঈদ উপলক্ষে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া। এ জন্য একটি লঞ্চের সিঙ্গেল কেবিনের টিকিট নিয়েছেন। কাউন্টারে কোনো ভিড় নেই। টিকিট পেতে কোনো ঝামেলা হয়নি। আগে দেড় হাজার টাকার নিচে ঈদের সময় সিঙ্গেল কেবিন মিলত না। এবার ১ হাজার টাকায় কেবিন পেয়েছেন।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads