• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
আমদানিনির্ভর চিকিৎসা সরঞ্জাম

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

আমদানিনির্ভর চিকিৎসা সরঞ্জাম

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ২৫ জুলাই ২০২২

দেশে চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির রয়েছে বিশাল বাজার। কারণ চিকিৎসাসেবা দিতে এখন আধুনিক সরঞ্জামের কোনো বিকল্প নেই। তবে দেশে ব্যবহূত চিকিৎসা সরঞ্জামের সিংহ ভাগই আমদানি করতে হয়। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু সে অনুপাতে দেশীয় উদ্যোক্তা বিকাশের হার বাড়েনি। এ খাতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোক্তরা মনোযোগ দিলে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে দেশের অর্থনীতিতে।

দেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, এর সুফল সরাসরি ভোগ করবে রোগীরা। কমে যাবে চিকিৎসা ব্যয়। একই সঙ্গে দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হলে তা যথেষ্ট বাজার পাবে বলে মনে করেন আমদানিকারকরা।

অন্যদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, শিগগির দেশে গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল সরঞ্জাম তৈরি শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এজন্য আরো অনেক সময় লাগবে। তবে এ খাতের বিকাশের জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। যতদিন মেডিকেল সরঞ্জাম তৈরিতে দেশকে স্বনির্ভর করা না যায়, ততদিন আমদানির ওপরই নির্ভর করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ইউএসএইড-এর প্রকাশিত সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার বছরে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের। যার ৮৫ শতাংশই আমদানি নির্ভর। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন শিল্পের যাত্রা শুরু হলেও এপর্যন্ত এই খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা মাত্র ৮টি। বাংলাদেশে এই পণ্যের বিশাল বাজার থাকলেও মাত্র ১৫ শতাংশের জোগান আসে এসব দেশীয় প্রতিষ্ঠান থেকে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকারে নীতি সহায়তা পেলে দেশের চাহিদার বড় একটি অংশের জোগান তাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব। দেশে শুধুমাত্র ইনজেকশন সরঞ্জাম ও কিছু নিরাপত্তামূলক যন্ত্রপাতি উৎপাদন হয়। বাকি সব ধরনের সাধারণ ও উচ্চপ্রযুক্তির (হাই-টেক) মেডিকেল সরঞ্জাম আমদানি আমদানি করা হয়। আমদানিকারক, সরবরাহকারী, প্রস্তুতকারক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং ভোক্তারা বলেছেন, করোনা মহামারির সময় দাম কম, অথচ খুব প্রয়োজনীয় মেডিকেল সরঞ্জামও সংগ্রহ করা যায়নি। যেমন- কোভিড-১৯ দেশে আঘাত হানার পরপরই একজন ব্যক্তির অক্সিজেন স্যাচুরেশন এবং পালস রেট নিরীক্ষণের জন্য একটি যন্ত্র ‘পালস অক্সিমিটার’ অতি প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমদানি মাধ্যমে সেটি সরবরাহ না থাকায় তখন সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল পুরো দেশ। এমন ছোট ডিভাইসগুল স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা গেলে প্রয়োজনে সহজে সকলের হাতে পৌঁছে যেত।  

জার্মান ওয়েব পোর্টাল স্ট্যাটিস্টা ডট কম-এর জরিপ মতে, ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী মেডিকেল ডিভাইসের বাজারের প্রাক্কলিত পরিমাণ ৪৫৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার বার্ষিক বৃদ্ধির হার (সিএজিআর ২০২২-২০২৭) ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০২৭ সাল নাগাদ মেডিকেল যন্ত্রপাতির বার্ষিক বাজার হবে ৭৬৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, স্থানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে চাহিদার মাত্র ৫-৭ শতাংশ পূরণ হয়। এর পরিমাণ হতে পারে ৫৫-৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর মেডিকেল ডিভাইসস অ্যান্ড সার্জিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার-এর হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার মেডিকেল ডিভাইসের চাহিদা রয়েছে, যা সামপ্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বিশ্ববাজারে পাওয়া মোট ২ মিলিয়ন ধরনের চিকিৎসা যন্ত্রের মধ্যে মাত্র ৩০ হাজার ধরনের মেডিকেল সরঞ্জামের চাহিদা রয়েছে এ দেশে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আইটেমগুলোর মধ্যে, বেশিরভাগই ব্যবহারযোগ্য/নিষ্পত্তিযোগ্য। ভোগ্যপণ্য ছাড়াও, বাংলাদেশ অর্থোপেডিক পণ্য, অস্ত্রোপচারের জীবাণুনাশক, হাসপাতালের আসবাবপত্র, হোম কেয়ার ডিভাইস, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম এবং অন্যান্য ছোট যন্ত্র উৎপাদন করে, যদিও তা স্বল্প পরিসরে। জেএমআই, এএনসি, গেটওয়েল, অপসোনিন, ইনসেপ্টা হাইজিন অ্যান্ড হসিপিকেয়ার, টেকনো ড্রাগ, বি-বিট এবং প্রোমিক্সকো নামের দেশি কোম্পানিগুলো এসব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি উৎপাদন করছে। 

দেশের চিকিৎসকরা সারা বছর হূদরোগ, ক্যানসারের চিকিৎসা এবং কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য প্রচুর উচ্চপ্রযুক্তির (হাই-টেক) মেডিকেল ডিভাইস ব্যবহার করছেন। এসব আইটেমের বেশিরভাগই আমদানি করা হয়। দেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত কিছু আমদানি করা উচ্চ প্রযুক্তির ডিভাইসের মধ্যে রয়েছে কার্ডিয়াক স্টেন্ট, কার্ডিয়াক পেসমেকার, কৃত্রিম হার্ট ভালভ, ডিজিটাল রক্তচাপ মনিটর এবং ডিভাইস, শ্রবণ সহায়ক ডিভাইস, রক্তের ব্যাগ, প্রস্রাবের ব্যাগ, ডায়ালাইজার টিউব, মেডিকেল ভেন্টিলেটর, ডিজিটাল থার্মোমিটার এবং এক্স-রে এবং আল্ট্রাসাউন্ড মেশিন।

দেশীয় প্রস্তুতকারকদের মতে, মেডিকেল ডিভাইসে পর্যাপ্ত ডেটা ব্যাঙ্কের অভাব রয়েছে। এছাড়া ভুল ঘোষণাসহ আমদানি করা ডিভাইসের মূল্য হ্রাস, অপর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রক নির্দেশিকা এবং সন্দেহজনক মূল্য ও মানে ডিভাইসগুলোর নিয়ন্ত্রণ এবং অবশেষে সুসংজ্ঞায়িত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতামূলক ব্যবস্থা না থাকায় যত্রতত্র মেডিকেল যন্ত্রপাতি আমদানি হয়।

বাংলাদেশ মেডিকেল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, আমদানিকারকরা নিজেরাই মেডিকেল ডিভাইস তৈরির কারখানা স্থাপনের সক্ষমতা রাখেন না। অথচ ভোক্তারা এখানে তৈরি পণ্যের মান নিয়ে সন্দিহান থাকেন।

হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে সরকার খুব একটা সহযোগিতা করছে না। করোনা মহামারি যেহেতু বাস্তব পরিস্থিতি উদ্ঘাটন করেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ শিল্পের ওপর জোর দিয়েছেন। আর তাই ওষুধ শিল্পের কিছু কোম্পানি মেডিকেল ডিভাইস শিল্পে আগ্রহী হচ্ছে।

জেএমআই সিরিঞ্জস অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসের (জেএসএমডি) নির্বাহী পরিচালক (ইডি) অভিজিৎ পল বলেন, সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা ডিভাইসের দেশে একটি খুব বড় বাজার রয়েছে। একক পণ্য বাজারের স্কেল বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি প্রধান নিরুৎসাহিত কারণ। যন্ত্রপাতির জন্য বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু অন্যান্য প্রচলিত শিল্পের তুলনায় এ শিল্পে সুবিধা দেরিতে আসে। এছাড়াও, মেডিকেল ডিভাইসের অননুমোদন গতি এবং ভুল তথ্য দিয়ে ডিভাইস আমদানি করা। যা স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের জন্য আরেকটি বাধা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে যে দেশে ১০ হাজার কোটি টাকার মেডিকেল বাজার থাকলেও দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭২২ দশমিক ৬৫ কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করেছে। যা ২০১৯-২০ সালে ছিল ৫ হাজার ০৫৯ দশমিক ৮৭ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা এবং ২০১৭-১৮ সালে ৫ হাজার ১০৩ দশমিক ১৪ কোটি টাকা এবং ২০১১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ হাজার ১২০ দশমিক ০৭ কোটি টাকা।

হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম শফিউজ্জামান বলেন, কয়েকটি কোম্পানির জন্য সব চাহিদা পূরণ করা কঠিন হবে। এই খাতে শূন্যতা পূরণের জন্য আমাদের বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন। উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানিও আরেকটি অপূর্ণতা। সরকারের উচিত অফিসিয়াল প্রক্রিয়া সহজ করা এবং বাজারে প্রবেশাধিকার প্রদানকারী নির্মাতাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের অভাবে অনেক বিনিয়োগকারী তাদের এই খাতে বিনিয়োগ করতে বাধা দেয়।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (প্রশাসন) আইয়ুব হোসেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয় যে, দেশে চিকিৎসা যন্ত্রে স্বাবলম্বী হওয়া। তবে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহমূলক পরিবেশ থাকলে তা অর্জন করা সম্ভব।

তিনি জানান, প্রস্তুতকারককে উৎসাহিত করার অংশ হিসেবে তারা মেডিকেল ডিভাইস আমদানির সীমিত অনুমতি (শুধু প্রয়োজনীয় ডিভাইসের জন্য) দিচ্ছে। আমরা শিগগিরই এই উদ্যোক্তাদের দেশে প্রতিষ্ঠান করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads