• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
আতঙ্কের জনপদ বান্দরবান সীমান্ত

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

আতঙ্কের জনপদ বান্দরবান সীমান্ত

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২

বান্দরবানের সীমান্ত এখন আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘর্ষে এখন চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে মর্টারশেল পড়া, হেলিকাপ্টার থেকে গুলি এসে পড়েছে। এসব ঘটনায় মায়ানমার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হলেও কোনো কাজে আসছে না। গতকাল বুধবারও টানা গুলিবর্ষণে চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ আতঙ্কের মধ্যে সেখানকার কৃষকরাও জুমসহ তাদের কৃষিপণ্য ঘরে তুলতে পারছে না।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে আবারও গোলাগুলি শুরু হয়েছে। গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। টানা দুই দিন গোলাগুলির শব্দে সীমান্তের বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক বাড়ছে।

তুমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা মাহামুদুল হক বলেন, সকাল থেকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আবারো গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। শব্দগুলো বিকট; মর্টারশেলের আওয়াজ মতো। তবে আকাশে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান উড়তে দেখা যায়নি।

ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তে দুই দিন গোলাগুলি বন্ধ থাকায় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সকাল থেকে আবারো গোলাগুলি শুরু হওয়ায় ভয়ে আছে সীমান্তের লোকজন। গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মর্টারশেল ছোড়া হচ্ছে। শব্দগুলো বিকট। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এতে লোকজনের মাঝেও ভয়ভীতি বাড়ছে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালমা ফেরদৌস বলেন, তুমব্রু সীমান্তে রাখাইনে সকাল থেকে আবারো গোলাগুলি চলছে বলে স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়েছি। এ বিষয়ে আমাদের সীমান্ত বাহিনী কাজ করছে। সীমান্তের বাসিন্দাদের আতঙ্কিত না হতে বলা হচ্ছে।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার (এসপি) তারিকুল ইসলাম তারিক জানান, সীমান্তে আজকেও গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে। সীমান্তে বসবাসকারীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দেশটির সেনাবাহিনীর বারবার মর্টারশেল বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে গ্রামবাসী। বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে তাদের ঘরবাড়ি। আকাশ-সীমায় চক্কর দিচ্ছে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার।

তুমব্রু গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখানে খুব ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। প্রতিদিন আমাদের মাথার ওপর দিয়ে গুলিবর্ষণ হচ্ছে। আমরা যেন গুলির নিচে অবস্থান করছি।

একই গ্রামের জাহিদ হোসেন জানান, তারা যেন যুদ্ধের মধ্যে রয়েছেন। প্রায়ই তাদের গ্রামের ওপর দিয়ে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার যায়। গোলাবারুদের শব্দে বাচ্চারা আঁতকে ওঠে। মাঝে মধ্যে সীমানার কাঁটাতারের ওপর পাশে মিয়ানমারে অস্ত্রধারী লোকজনকে দেখা যায়। কদিন আগেও তুমব্রু উত্তরপাড়ায় ২টা মর্টারশেল পাওয়া গেছে। যেগুলো মিয়ানমার থেকে এসে পড়েছে। এতে কারও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। পরে বাংলাদেশের সেনারা এসব ধ্বংস করে। কিন্তু আমাদের নিরাপত্তাটা কোথায়? এই বোমাগুলোত বিস্ফোরিত হতে পারত?’

আরেক গৃহবধূ সাদিয়া বেগম জানান, প্রতিদিন এখানে বোম আর গুলির শব্দে আমাদের সন্তানেরা ভয়ে থাকে। ঘরের লোকজন আতঙ্কে কাজে যেতে চায় না। মনে হয় এই বুঝি মাথার ওপর বোম পড়ল। পার্শ্ববর্তী দেশের এমন আচরণে আতঙ্কে থাকতে চাই না। আমরা এর সমাধান চাই।

তিনি বলেন, আমরা এক প্রকার ঘর থেকে বের হতে পারছি না। জমি থেকে কোনো ফসলও ঘরে আনতে পারি না। জমিতেই ফসল নষ্ট হচ্ছে।

এসব ঘটনায় আতঙ্কে দিন পার করছেন সীমান্তের এপারে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের বাসিন্দারা। গত প্রায় একমাস ধরেই এ অবস্থা চলমান।

জানা যায়, উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখা এবং ওই দেশের সীমান্তবর্তী ১৬ কিলোমিটার এলাকায় চলছে তুমুল গোলাগুলি ও গোলাবর্ষণ। এসবের শব্দে কেঁপে উঠছে ঘরবাড়ি। এরই মধ্যে মায়ানমারের মর্টারশেল এসে বাংলাদেশের সীমান্তে পড়ছে। হেলিকাপ্টার দিয়ে গুলিবর্ষণের পাশাপাশি মর্টারশেল বাংলাদেশ সীমান্তেও এসে পড়ছে। যার কারণে চরম আতঙ্কগ্রস্ত সীমান্তের বাসিন্দারা।

জানা গেছে, ঘুমধুমের তুমরু গ্রামের পূর্বাংশের শূন্যরেখায় থাকা ৫ হাজার রোহিঙ্গারা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ, ঘটনাস্থলের খুব কাছেই অস্থায়ী ঝুপড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তারা। যার ৫০ গজের মধ্যে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর যাতায়াত সড়ক। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সীমাবর্তী অন্তত ২০ গ্রামের মানুষ রাতে ঘুমাতে পারে না গোলার আওয়াজে।

সীমান্তবাসী বলছেন, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মির সঙ্গে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এ গোলাগুলি হচ্ছে। তারা একে অপরের উদ্দেশে মর্টারশেলসহ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করছে।

সীমান্তের রেজুআমতলী, গর্জনবুনিয়া, বড়ইতলী সোনাইছড়ি ও আমতলীর বাসিন্দা, ক্যাচালনং তংচংগা, ফরিদুল আলম, মো. ইদ্রিস, উচালা মার্মা ও জোবেদা বেগমসহ অনেকে জানান, গত প্রায় একমাস ধরে মিয়ানমার বর্ডারের দিকে বিকট গুলির আওয়াজ শুনতে পান তারা। এমনকি মর্টারশেলের আওয়াজ তাদের আতঙ্কিত করে। সীমান্তের ৩৮ নম্বর পিলার থেকে ৪১ নম্বর পিলার পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকায় এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।

তারা বলছেন, এসব ঘটনায় রোহিঙ্গা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে চলে আসার চেষ্টা করছে। যেকোনো মুহূর্তে তারা ঢুকে পড়তে পারে। মূলত রোহিঙ্গা নিধনের জন্যই মিয়ানমার এ অভিযান চালাচ্ছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবুল কালাম সাংবাদিকদের বলেন, আমার বাড়ি আজুখাইয়া এলাকায়। সীমান্ত থেকে ৫ কিলোমটির দূরে। তবু গোলাগুলির আওয়াজে আমাদের ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠে। বর্তমানে মিয়ানমার সর্বোচ্চ সীমালঙ্ঘন করে চলেছে। প্রতিনিয়ত সীমান্তের এপারে গুলি আসছে। পরপর দু’বার মর্টারশেল পড়ার ঘটনাও ঘটেছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, আরাকান আর্মি নামক এক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংস্থা সেখানে অবস্থান করছে, যারা ওই এলাকা দখল করেছে। তাদের সাথে প্রতিনিয়ত মিয়ানমার আর্মির সংঘর্ষ হচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তে এসে গোলা পড়া অনুচিত, এটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আমাদের এখন দেখতে হবে গোলা পড়াটা ইচ্ছাকৃত নাকি তাদের সংঘর্ষের ফলাফল।

তিনি আরো বলেন, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, মিয়ানমার ইচ্ছাকৃত বাংলাদেশকে টার্গেট করে গোলাটা ছুড়ছে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সামরিক সক্ষমতা বজায় রেখে ভবিষতে যেন গোলা এসে না পড়ে, সে বিষয়ে কূটনৈতিক চ্যানেলে এটি সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের উচিত সীমান্তে আরো নজরদারি বাড়ানো। সামরিক উত্তেজনা বাড়ানো যত সহজ, নিষ্পন্ন করা ততটাই কঠিন।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমরা তথ্যটা পেয়েছি। পাশাপাশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ সতর্কবস্থায় আমরা রয়েছি।

এর আগে ২৮ আগস্ট বেলা ৩টার দিকে মিয়ানমার থেকে নিক্ষেপ করা দুটি মর্টারশেল অবিস্ফোরিত অবস্থায় বান্দরবানের ঘুমধুমের তমব্রু উত্তর মসজিদের কাছে পড়ে। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি গোলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঘুমধুম এলাকায় পড়ে। এসব ঘটনায় মায়ানমার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু প্রতিবাদ জানালেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads