• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯

মতামত

কুকুরই প্রমাণ করল সে পশু নয়

  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০১৮

কনকনে শীত, গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি, ২০ এপ্রিল ২০১৮-এর ঘটনা। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের দুর্গম এলাকার একটি বাড়ি থেকে ‘অরোরা’ নামে তিন বছরের এক শিশু হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে। শিশুটি যে কখন বেরিয়েছিল তা বাড়ির কেউ জানত না। আত্মীয়স্বজন তন্নতন্ন খোঁজাখুঁজি করেও কোথাও শিশুটির সন্ধান পায়নি। শেষে নিরুপায় হয়ে অভিভাবক মহল বিষয়টি থানা পুলিশ পর্যন্ত জানাতে বাধ্য হয়। ১৫ ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে ওই বাড়ির ম্যাক্স নামের পোষা অন্ধ কুকুরটিকে তারা খুঁজে পায়। প্রভুর আগমন টের পেয়ে অন্ধ ম্যাক্স তাদের হারিয়ে যাওয়া ‘অরোরা’র কাছে নিয়ে যায়। পাহাড়ঘেরা দুর্গম এলাকার হিংস্র পশুর হাত থেকে শিশুটিকে রক্ষার জন্য এই ম্যাক্সই পনের ঘণ্টা তার বুকে আগলে রেখেছিল। শিশুকে খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে বিস্তারিত শুনে ম্যাক্সের ওপর খুশি হন। পরে পুলিশ বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান। ম্যাক্সের ছবিসহ খবরটি অস্ট্রেলিয়ার বহুল প্রচারিত একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই সংবাদ আমাদের দেশের জাতীয় একটি দৈনিক পত্রিকাতেও অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে।

২০১১ সালের নভেম্বরে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘মায়ের কোলে ওদের ঠাঁই হয় নাই।’ ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নবজাতক শিশুকে যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হচ্ছে। গত ১৭ নভেম্বর এমন দুটি শিশু পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। রিপোর্টার ঢামেকের বরাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘চলতি বছরের ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের দিন এক নবজাতক শিশু উদ্ধার করা হয় ঝিনাইদহের শৈলকুপায়। দুটি কুকুরের মাহাত্ম্যের গুণে ওই শিশু বেঁচে ছিল। কে বা কারা উপজেলার হাবিরপুর চাতালের পাশে শিশুটিকে ফেলে যায়। রাতভর দুটি কুকুর সেই নবজাতক শিশুকে পাহারা দেয়। সকালে চাতাল শ্রমিক সখিরন নেছা শিশুটিকে উদ্ধার করে।’ গত ২৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতা সিঙ্গেল কলামে প্রকাশিত আরো একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘বড়দের শত্রুতায় প্রাণ গেল শিশুর।’ সংবাদে বলা হয়েছে, নিখোঁজের ১৭ ঘণ্টা পর বাড়ির আঙিনার মাচায় পাওয়া গেছে তিন বছরের শিশু তামিম হোসেনের লাশ। ধারণা করা হচ্ছে, শত্রুতার জেরে এই শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে খুনিরা। আক্রোশ প্রকাশ করতেই হত্যার পর শিশুটির লাশ বাড়ির আঙিনায় ফেলে রাখা হয়। নির্মম এই ঘটনাটি ঘটে গত ২৭ এপ্রিল, রাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা বাইপাস এলাকায়। নিহত তামিম হোসেন নির্মাণ শ্রমিক রাসেল হোসেনের ছেলে। গত ২৭ এপ্রিল একটি অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদ হলো-লাবিব নামের ৬ বছর বয়সের এক শিশুকে অপহরণের পর প্যাকেটের জুসে নেশাজাতীয় ওষুধ মিশিয়ে হত্যা করে অপহরণকারীরা। নিহত শিশু জামালপুর সদর উপজেলার বাঁশচড়া ইউনিয়নের ঝাউলা গোপালপুরের বন্দেবাড়ি গ্রামের ওমান প্রবাসী ইউসুফ আলীর ছেলে। ২৮ এপ্রিল অন্য একটি অনলাইনের সংবাদ ছিল, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বৈদ্যের বাজার ইউনিয়নের দাউদেরগাঁও গ্রামে সৌদি প্রবাসী আনিসুর রহমানের মেয়ে আনিছার লাশ একটি পানির ট্যাঙ্ক থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। আনিছা সোনারগাঁ উলুকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। শিশুটি ২৩ এপ্রিল প্রাইভেট পড়তে গিয়ে নিখোঁজ হয়। বিভিন্ন স্থানে খোঁজার পর বুধবার মেয়েটির চাচা আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে থানায় জিডি করেন। শুক্রবার সকালে উলুকান্দি গ্রামের আবদুল মালেক মিয়ার নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তলার পানির ট্যাঙ্ক থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সংবাদটিতে এই শিশু খুনের কোনো ক্লু উল্লেখ নেই। ২৮ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদে প্রকাশ- নাটোরের গুরুদাসপুরে তিন বছরের ও বড়াই গ্রামে দুই বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য, থানায় কেউ অভিযোগ করেনি। শিশু নুসরাত ধর্ষণের শিকার ও খুন হয়েছে। এ ছাড়া ৮ বছরের পূজা, সাদিয়ারা মানব-পশুদের হাতে জীবন দিয়েছে।

লেখাটি যখন তৈরি করা হচ্ছে, তখন দেবরের সঙ্গে ভাবীর পরকীয়ায় আগুনে পুড়িয়ে নিজের শিশুসন্তানকে হত্যার জঘন্য খবরটি চোখ এড়ায়নি। দুই দিনব্যাপী বিভিন্ন মিডিয়ায় খবরটি গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়।

সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরে আট বছর বয়সী শিশু আসিফাকে একটি মন্দিরের ভেতরে আটকে রেখে নরপিশাচরা গণধর্ষণ করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা ভারত ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। ভারত সরকার শিশু ধর্ষণকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস করে।

 সে যাই হোক, অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে কুকুর দেখে ভয় পান, আমি নিজেও ভয় পেতাম। আজ কয়েক দিন ধরে কুকুরের ওপর থেকে ভয় কেটে গেছে। ওদের আদর করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। পাশাপাশি মানুষ দেখলেই কেমন যেন মনে সন্দেহ জাগে। ভয় হয়। ‘দ্বার বন্ধ করে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি।’ বাণীটি বুকে ধারণ করে সময় পার করছি। জঙ্গলঘেরা ঐরাবত (পাগলা হাতি) যখন লোকালয়ে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালায়, তখনো এই হিংস্র পশুরা শিশুকে স্পর্শ করে না। আমরা দেখেছি কোনো পশুই কোনো পশুর বাচ্চাকে হত্যা করেনি। অন্ধ কুকুর ম্যাক্স কিংবা ঝিনাইদহের সেই দুটি কুকুরের মাহাত্ম্যের কাছে মানুষ নামের জানোয়ারদের কোনো মূল্য আছে কি? কুকুরই প্রমাণ করল সে কুকুর নয়, মনুষ্য পশুরাই প্রমাণ করে তারা কুকুরেরও অধম। ভারতের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি ভারতের মানবতা ফুঁসে উঠতে পড়তে পারে, তাহলে আমরা কেন দেশের মনুষ্য পশুদের নিষ্পাপ শিশু ধর্ষণ-খুনের মহোৎসব নীরবে অবলোকন করছি? তবে কি মনুষ্য পশুর কাছে আমাদের মানবতার মৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে! আমরা কি এই পশুদের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে জাগিয়ে তুলতে পারি না? আর দেরি নয়, এখনই শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, সমাজ একযোগে সবাইকে মনুষ্যরূপী পশুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে— এটা সময়ের দাবি।

রহিম আব্দুর রহিম

সাংবাদিক, নাট্যকার ও শিক্ষক

ই-মেইল: rahimabdurrahim@hotmail.com

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads