• শনিবার, ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪২৯

প্রতীকী ছবি

মতামত

উন্নয়নের স্বার্থে ‘ফ্রি ট্রেড’ জোন জরুরি

  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০১৮

চীনের হাইনান প্রদেশে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বোয়া ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলন। এই সংগঠনের ইনিশিয়াল ফাউন্ডার মেম্বার ও বাংলাদেশের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে এই লেখক অংশগ্রহণ করেন। বিগত ৮-১১ এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সম্মেলনে  চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং এশিয়ার অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধি  যোগ  দেন। চীনের হাইনান প্রদেশের বোয়া সিটিতে চার দিনব্যাপী এ সম্মেলন হয়ে উঠেছিল এশিয়ার উন্নয়নে এক দিকনির্দেশনা ও নতুন নতুন উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচি প্রশ্নে ঐকমত্যের কেন্দ্র, যা এশিয়াসহ বিশ্ব উন্নয়নের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

চীনের হাইনান প্রদেশে অনুষ্ঠিত বোয়া ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) বার্ষিক সম্মেলনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ভাষণ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, যুগোপযোগী ও বাস্তবমুখী। ভাষণে তিনি এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়নের ওপর জোর দেন। সেই সঙ্গে এশিয়া ও গ্লোবাল উন্নয়নে চীনের অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। চীনা নেতা বিশ্ব-বাণিজ্যের সংরক্ষণ নীতির ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক গ্লোবালাইজেশনে চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার ও অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতির ওপর আলোকপাত করেন। তার মতে, পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এশিয়াসহ সারা বিশ্বের উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘স্নায়ুযুদ্ধ ও একলা চল নীতি এখন অচল। অন্যকে দাবিয়ে রাখা, অধিকারবঞ্চিত করা- এখন আর সম্ভব নয়। আজকের পৃথিবীতে শান্তি ও উন্নয়ন গণ-মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিভূ।’ এ লক্ষ্যে তিনি বিনিয়োগ এবং বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দেন। তার মতে, পরিবেশ হচ্ছে স্বচ্ছ বাতাসের মতো এবং একমাত্র বিশুদ্ধ বাতাসই অধিকতর বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে।

আমরাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীনা প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে পারি। কেননা এশিয়া ও বিশ্ব-ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ আজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি ইতোমধ্যে অনুন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পরিকল্পনা হলো- ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে বাংলাদেশকে উন্নীত করা। এ লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যে কৃষিসহ অর্থনীতির বিভিন্ন নির্ণায়কে অগ্রগতি লাভ করেছি। অর্থনীতির বিকাশে বাংলাদেশ ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা, বাণিজ্য, কৃষি ও ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে হুবহু দুবাই, সিঙ্গাপুর, চীন ও থাইল্যান্ড এবং সুইজারল্যান্ডের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু প্রয়োজন সমন্বয়, প্রশাসনে মেধাবীদের সম্পৃক্তকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগে বিশেষ সুবিধা প্রদান।

বোয়া ফোরাম ফর এশিয়ার নেতৃবৃন্দের আলোচনার প্রেক্ষিতে আমি মনে করি, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ‘ফ্রি-ট্রেড জোন’ গঠন করা জরুরি। এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে ইতোমধ্যে দুবাই সফল হয়েছে। ফ্রি-ট্রেড জোন হলো- একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে কর রেয়াত ও কাস্টম ডিউটিমুক্তসহ নানা উৎসাহমূলক প্রণোদনা দিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। দুবাইতে ৩০টির বেশি ফ্রি-ট্রেড জোন রয়েছে। এজন্য আমিরাত সরকার বিশেষ আইনি কাঠামো ও কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে। সেখানে তারা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ব্যবসার ১০০% মালিকানা, কর ও শুল্ক রেয়াত ব্যবস্থা, সম্পদের মালিকানা প্রদান, ব্যবসার গোপনীয়তা রক্ষার গ্যারান্টি, ব্যাংক হিসাব খোলার অধিকার, একাধিক ব্যবসায় বিনিয়োগের অবাধ সুযোগ প্রদান এবং ইচ্ছামাফিক ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার অধিকার প্রদান করেছে। এই ফ্রি-ট্রেড জোন দুবাইসহ আমিরাতের উন্নয়নে এক অনন্য রোল মডেল। যেকোনো দেশ এ মডেল গ্রহণ করে লাভবান হতে পারে। উন্নত দেশ হওয়া সত্ত্বেও চীন এই অবাধ ফ্রি-ট্রেড নীতি হাইনান প্রদেশের বোয়াতে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

আমার জানা মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৮টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন আছে- যা এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন হিসেবে পরিচিত। নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যম আয়ের দেশ ও উন্নত দেশে উন্নীত করতে হলে দুবাই ও চীনের বোয়ার আদলে বাংলাদেশে ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। এই ‘ফ্রি-ট্রেড জোন’ বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার যাবতীয় উপাদান বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যমান। পণ্য চলাচলে রয়েছে সামুদ্রিক বন্দর ও এয়ার রুট। আমাদের পণ্যের রয়েছে ইউরোপসহ বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে শুল্কমুক্ত এবং কোটা ফ্রি প্রবেশাধিকার। রয়েছে আকর্ষণীয় ব্যবসা ও বিনিয়োগের সুন্দর পরিবেশ এবং ১৬ কোটি ৪০ লাখ অধ্যুষিত জনসংখ্যার দেশের পণ্যের বাজার। আমাদের আছে দক্ষ যুবশক্তি। রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, পানি ও উর্বর ভূমি। আমরা যদি বাংলাদেশের সুবিধাজনক জায়গায় ‘ফ্রি-ট্রেড জোন’ গঠনে হুবহু দুবাইয়ের নীতি গ্রহণ করি, বোয়ার উদ্যোগকে ধারণ করি, তাহলে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নপূরণে, উন্নত বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে। এ ক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, পদ্মার দক্ষিণ পার- মাদারীপুর ও শরীয়তপুরের যেকোনো উপযুক্ত জায়গা, এটা শিবচর বা পদ্মা নদী সংলগ্ন যেকোনো স্থান ও খেপুপাড়ার পায়রা বন্দর এলাকা হতে পারে। উপযুক্ত জায়গা চিহ্নিত করে মাদারীপুর-শরীয়তপুর ও খেপুপাড়ায় আলাদা দুটি ফ্রি-ট্রেড জোন প্রতিষ্ঠা করা যায়। ফ্রি-ট্রেড জোনের সুবিধা প্রাপ্তির জন্য পদ্মার তীরে একটি কন্টেনার পোর্টও নির্মাণ করতে হবে।

সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনের হাইনান প্রদেশের বোয়ায় একটি ফ্রি-ট্রেড জোন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানান। তিনি বলেন, চীনের একটি প্রবাদ আছে- মাটির সমন্বয়ে পর্বতের সৃষ্টি। পানির সমন্বয়ে সমুদ্র সৃষ্টি। মানুষের সুখ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎও এমনিতেই এসে যায় না। পানির মধ্যে যেমন সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করি, তেমনি বিভিন্ন এলাকার উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয় সে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে। অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি চীনের দ্বিতীয় বিপ্লবের অংশ। এ দ্বিতীয় বিপ্লব শুধু চীনের নিজস্ব উন্নয়ন নয়, এ উন্নয়নের আবর্তিত ফলাফলে প্রভূত উপকৃত হবে সারা বিশ্ব। চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি হবে সফলতার স্মারক। আমি দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে চাই, চীন তার অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি পরিত্যাগ করবে না এবং এ নীতি উন্মুক্ত থাকবে। ক্রমান্বয়ে এর পরিধি বাড়বে। যারা সংস্কার নীতি ও নতুন উদ্ভাবনী কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করবে তারা পেছনে পড়ে থাকবে এবং তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।

সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক মন্ত্রী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads