• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

মতামত

রবীন্দ্রনাথের স্বনির্ভর অর্থনীতি

  • প্রকাশিত ০৮ মে ২০১৮

জমিদারির প্রথাগত দম্ভ, লালসা, অহমিকা, শাসন-শোষণ এসব কিছুকে ছাড়িয়ে তিনি ছিলেন মানুষের কবি। তিনি প্রজা-দরদী এক জমিদার কবি— বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মানুষের অভাব, দুঃখ দূর করার জন্য মানুষের নিজস্ব সক্ষমতার কথা বার বার বলেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষের মাঝেই আছে সম্পদ সৃজনের লুকায়িত ক্ষমতা। আছে অপার সম্ভাবনা। সঠিকভাবে এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারলেই দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন, সমাজের বৃহৎ অংশকে নিচে ফেলে উন্নয়নের শিখরে ওঠার অহংকার করা যায় না। তার কবিতায় একই বিষয়ের প্রতিধ্বনি শোনা যায়— ‘যারে তুমি নিচে ফেল তোমারে বাঁধিবে সে নিচে/পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে/পশ্চাতে টানিছে।’ দারিদ্র্য শুধু ধনের নয়, মনেরও। মনের দরিদ্রতা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘ভালো করিয়া ভবিয়া দেখিলেই দেখা যাইবে দারিদ্র্যের ভয়টাও ভূতের ভয়। এটা কাটিয়া যায় যদি আমরা দল বাঁধিয়া দাঁড়াইতে পারি। বিদ্যা বলো, টাকা বলো, প্রতাপ বলো, ধর্ম বলো— মানুষের যা কিছু দামি এবং বড় তাহা মানুষে দল বাঁধিয়াই পাইয়াছে।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘বালি জমিতে ফসল হয় না। কেননা তাহা আঁটা বাঁধে না, তাই তাহাতে রস জমে না। ফাঁক দিয়া সব গলিয়া যায়।’

প্রজা-দরদী রবীন্দ্রনাথ কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে খুব ভাবতেন। তিনি কৃষিকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। সে সময় সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাংক বলে কোনো ধারণাই ছিল না। তখন তিনি প্রজাদের মিতব্যয়িতা, সংঘবদ্ধ হয়ে কর্ম এবং সহায়তার অভ্যাস শিক্ষা দেওয়ার জন্যে ১৯০৫ সালে তার নোবেল পুরস্কারের টাকা দিয়ে পতিসরে কৃষকের জন্য কৃষি ব্যাংক স্থাপন করলেন। তিনিই প্রথম ক্ষুদ্রঋণের প্রচলন করেছিলেন। তার ব্যাংক খোলার পর বহু গরিব প্রজা প্রথম সুযোগ পেল ঋণমুক্ত হওয়ার। রবীন্দ্রনাথ কবি হলেও প্রজাদের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব-অভিযোগ ইত্যাদি কারণে তিনি হয়েছেন প্রজা-হিতৈষী জমিদার। রবীন্দ্রনাথ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন কী করে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনা যায়। রবীন্দ্রনাথ বহু দেশ ভ্রমণ করে আহরিত জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগাবার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড থেকে সমবায়ের সাফল্যের উদাহরণ গরিবি হটাতে কাজে লাগাবার উদ্যোগ নিয়েছেন। সমবায় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, একা অন্ন ভক্ষণ করা যায়, তাতে হয়তো পেট ভরে। কিন্তু পাঁচজন মিলে খেলে পেটও ভরে, আনন্দও মেলে এবং সম্প্রীতির ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়।

রবীন্দ্রনাথের পল্লী উন্নয়ন ভাবনায় মূল বিষয় ছিল কৃষিতে ও অন্যান্য গ্রামীণ পেশায় আধুনিকতার পত্তন, গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট কুটিরশিল্পের বিকাশ ঘটানো এবং সমবায়ভিত্তিক কার্যক্রমের মাধ্যমে আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল মানুষ ও স্বনির্ভর অর্থনীতির সমাজ গঠন। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন ‘গ্রামগুলো আবার আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে উঠুক, তার অর্থ এই নয় যে, গ্রাম্যতা ফিরে আসুক। তিনি বলেছেন, কৃষিতে যান্ত্রিক সহায়তার কথা, আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের কথা- চরকার বদলে যন্ত্র তার কাম্য, তবে যান্ত্রিকতা নয়। রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন ‘মডেল’-এর মূল কথা সমবায় নীতি। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন সামাজিক জীবনে, ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমবায়ী আদর্শের ঐক্যবোধ-পারস্পরিক মিলন শুধু স্বার্থনির্ভর নয়, মানবিক চেতনা-নির্ভরও। তাই আশাহীন মানুষের মাঝে ভরসা জোগাতে তিনি বলেছেন, ‘সকল দেশেই গরিব বেশি ধনী কম। তা-ই যদি হয়, তাহলে কোন দেশকে বিশেষ করিয়া গরিব বলিব? যে দেশে গরিব ধনী হইবার ভরসা রাখে সে দেশে সেই ভরসাই একটা মস্ত ধন। আমাদের দেশে টাকার অভাব আছে এ কথা বলিলে সবটা বলা হয় না। আসল কথা, আমাদের ভরসার অভাব। তাই যখন আমরা পেটের জ্বালায় মরি তখন কপালের দোষ দিই।’ এ কথার মাধ্যমে তিনি মানুষকে ভাগ্যের দোষ না দিয়ে নিজেদের মিলিত সামর্থ্য নিয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বোঝাতে চেয়েছেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সামাজিক জীবনে কেবল একজন প্রজাবান্ধব জমিদার ও সমাজ সংস্কারক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন তা নয়, বরং আধুনিক কৃষির একজন রূপকার হিসেবেও তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন, গ্রামের উন্নতির মধ্যেই সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভরশীল। কেননা, আমাদের শহুরে জীবনের  উপভোগ্য অধিকাংশই গ্রাম থেকে আসে। তাহলে গ্রামের কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারলেই সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন ঘটবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের জন্য কৃষিকে বহুমুখী করার কোনো বিকল্প নেই। তাই তিনি কী করে কৃষককে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করা যায়, উৎপাদন বাড়াতে কীভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো যায়, কৃষকের সন্তানকে কী করে শিক্ষা দেওয়া যায়— এসব নিয়ে ভেবেছেন এবং কাজ করেছেন।

কৃষির উন্নয়নে তিনি নিজের সন্তান, জামাতা এবং বন্ধু-পুত্রকে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে না পাঠিয়ে ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য পাঠান। কারণ, তিনি মনে করতেন উচ্চশিক্ষায় উন্নত ভদ্রলোক হওয়ার চেয়ে উন্নত কৃষক হওয়া বেশি প্রয়োজন। কবিগুরুর পুত্র রথীন্দ্রনাথ ১৯০৯ সালে পিতার নির্দেশে ইউরোপের কিছু দেশ ঘুরে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষির আরো কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন। একই সময়ে তার প্রস্তুতি চলতে থাকে শিলাইদহে একটি আধুনিক কৃষি খামার এবং গবেষণাগার গড়ে তোলার। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের পেশা কৃষির উন্নয়ন ঘটাতে পারলেই দেশের উন্নতি করা সম্ভব। তবে তার মতে, কৃষি মানে শুধু ফলন বৃদ্ধি করা নয়- কৃষকের হাতে তার ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রদান এবং আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে কৃষকদের উৎপাদনে আগ্রহী করে তোলাই হবে সফলতার দাওয়াই। তিনি বিশ্বাস করতেন, পল্লীর উন্নয়ন ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পল্লী জনগোষ্ঠীর মানোন্নয়ন করা না গেলে সমগ্র দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। আর তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনের পাশে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি জানতেন, তার একার পক্ষে সমগ্র দেশকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তাই তার সরল স্বীকারোক্তি ও আকাঙ্ক্ষা, ‘আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না। আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি ছোট গ্রাম। আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা-অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোট আদর্শ তৈরি হবে।’

কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর, খুলনার দক্ষিণডিহি ও পদ্মার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল কর্ম ও সাধনার। বাংলাদেশের সবুজ ভূমিতে তার শ্রেষ্ঠ লেখাগুলো রচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে তার গান বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করেছে, আর তার লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পায়। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও তার লেখা। তিনিই একমাত্র কবি যিনি তিনটি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। প্রজা-হিতৈষী জমিদার কবি হয়ে নারী ও মানবতার মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে তাদের শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন। সাহিত্যের সমান্তরাল তিনি ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি ও সমাজভাবনা সমানভাবে চালিয়ে গেছেন। মানুষের জন্য, দেশের জন্য, সমাজ ও শিল্প এবং সংস্কৃতির জন্য তার ভাবনা যুগে যুগে আমাদের আলোকিত পথের সন্ধান দেবে।

 

এস এম মুকুল

সাংবাদিক

writetomukul36@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads