• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯
মাদক

হতাশ মানুষ নেশা করে তার দুঃখ-বেদনা ভুলে থাকতে চায়

আর্ট : রাকিব

মতামত

মাদক

  • আবদুল মতিন খান
  • প্রকাশিত ০৭ জুন ২০১৮

মাদক নিয়ে হালে খুব হৈচৈ হচ্ছে। হওয়ার কারণ এর গ্রহণ বেড়ে যাওয়া। মানুষ যখন পৃথিবীতে প্রথম বিবর্তিত হয় অর্থাৎ মানুষ যখন প্রথম পৃথিবীতে মানুষের অবয়বপ্রাপ্ত হয় অর্থাৎ স্বর্গ থেকে মর্তে পতিত হয়, তখন প্রথম যে সমস্যায় সে পড়ে সেটা খাদ্যের। স্বর্গে যতদিন ছিল ততদিন তাদের এ সমস্যা ছিল না। স্বর্গে প্রথম পুরুষ ও তাকে সঙ্গ দিতে তার পাঁজর থেকে নেওয়া একটি হাড় থেকে সৃষ্ট নারী উভয়েই ছিল নিরাবরণ, নিরাভরণ তো বটেই। স্বর্গে ক্ষুধা ও লজ্জা কোনোটারই বালাই ছিল না তাদের। এ দুই ‘কু’-উপসর্গ দেখা দিল শয়তানের পাল্লায় পড়ে পৃথিবীতে পতিত হওয়ার পর।

পৃথিবীতে এসে তারা দেখল স্বর্গের কোনো সুবিধাই এখানে নেই। উপরন্তু পৃথিবীতে এসে তারা আর যে সমস্যায় পড়ল, সেটা হলো, উলঙ্গ থাকার লজ্জা। খিদে এবং লজ্জা নিবারণ-  আশু সমস্যা দুটির সমাধানে তাদের তৎপর হতে হলো। পৃথিবীতে এসে দেখল, এখানে গাছপালা আছে। আছে তাতে ফলফলাদি। পৃথিবীর অনেক গাছের পাতা বেশ চওড়া। গাছের ফল ও পাতা দিয়ে তারা এটা করতে গিয়ে সন্ধান পেল এমন সব জিনিসের, যা খেলে নেশা হয়। ভালো লাগে। এই ভালো লাগা থেকে মাদকাসক্তি। মাদক স্থান করে নিল হতাশাগ্রস্ত ও অলস ধনীদের জীবনে। তার রেশ আজো চলছে এবং বেড়ে চলেছে। মিয়ানমারের ইয়াবা তার সর্বশেষেরটি। এরপর আরো মাদক তৈরি হবে এবং হতেই থাকবে, যতদিন মানবজাতি থাকবে। আহার ও পোশাকের প্রয়োজন মেটাল। পৃথিবীতে এসে তাদের দেখা দিল যৌন আকাঙ্ক্ষা। যৌনমিলনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে নারীর পেটে এলো সন্তান এবং নির্দিষ্ট সময় পর সে ভূমিষ্ঠ হলো। সন্তান জন্মদান চলতেই থাকল। তাতে পৃথিবীতে বাড়তে থাকল মানুষের সংখ্যা। সে সংখ্যা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে (২০১৮) দাঁড়িয়েছে আটশ’ কোটির কাছাকাছি। সারা পৃথিবীতে এখন আটশ’ কোটির মতো নরনারীর আহার, থাকার জায়গা বা বাসস্থান ও উদরপূর্তির জন্য খাদ্যের সমস্যা দেখা দিয়েছে।

আহার, বাসস্থান ও আচ্ছাদনের ব্যবস্থা পৃথিবীর সকল প্রান্তে অর্থাৎ সকল দেশে সমান প্রাচুর্যে হচ্ছে না। পৃথিবীর সব থেকে ধনী ও উন্নত দেশ বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, সে দেশে চরম দরিদ্রের সংখ্যা চার কোটি এবং দরিদ্রের সংখ্যা দুই কোটি। চরম দরিদ্র বলতে বোঝায় যারা খাওয়া, পরা ও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত ও দরিদ্র বলতে বোঝায় যারা এসব নিত্যপ্রয়োজন পুরো মাত্রায় পায় না। যুক্তরাষ্ট্রের যখন এই অবস্থা, তখন অন্যসব দেশের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিয়ে অনেকে কান্নাকাটি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের একজন ধনকুবের ইহুদি মন্ত্রী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে বলেছিলেন তলাশূন্য ঝুড়ি। তার কথা তখন অসত্য ছিল না। বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের মতো সব দেশকে ‘তলাশূন্য ঝুড়ি’ করে রেখেছিল বা রাখে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী ধনকুবের শাসকরা। দরিদ্র দেশগুলোকে তলাশূন্য ঝুড়ি করে রাখার সহজ হেতু হলো ক্ষুধার্তকে বশে রাখা ভরপেটে থাকাদের চেয়ে ঢের সহজ। যুক্তরাষ্ট্রের পাষণ্ড শাসকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ হলো দেখে যুক্তরাষ্ট্র তলাশূন্য দেশের মানুষকে শাস্তি দিতে তার পাঠানো খাদ্যবাহী জাহাজকে মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নেয়। তাতে খাদ্যাভাবে সদ্য স্বাধীন বিধ্বস্ত বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং এই দুর্ভিক্ষে প্রায় অর্ধ লাখ মানুষ না খেয়ে মরে। এই মহাবিপর্যয়ের জন্য সর্বাংশে দায়ী যুক্তরাষ্ট্র থাকলেও দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় বাংলাদেশ সরকারের ওপর। বিশেষ করে এর স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ওপর, যাকে তারা কিছুদিনের মধ্যে সপরিবারে ও কতিপয় আত্মীয়সহ হত্যা করবে বলে স্থির করে।

বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার পর বাংলাদেশকে তারা চরম প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক শাসক দ্বারা শাসিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অনুরূপ করে গড়ে তুলতে থাকে। বাঙালি বৈষয়িকভাবে দরিদ্র হলেও মানসিকভাবে তা নয়। বঙ্গবন্ধুর দুুই মেয়ে ১৯৭৫ হত্যাকাণ্ডের সময় ইউরোপে থাকায় তারা রক্ষা পান। তাদের বড়টি শেখ হাসিনা দেশে ফিরে রাজনীতির মাঠে পদার্পণ করলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে থাকে। তার প্রাগমেটিক বা প্রয়োগসিদ্ধ নীতি অনুসরণের ফলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় এবং অনাহারমৃত্যু হ্রাস পেতে পেতে হালে শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

দেশের এই যখন অবস্থা অর্থাৎ দেশ যখন তলাশূন্য ঝুড়ির স্তর থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্তরে উঠে গেছে বলে জাতিসংঘ এবং বিশ্বের যাবতীয় বৃহৎ ঋণদান সংস্থাগুলো মেনে নিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থাগুলোর অর্থসহায়তা ব্যতিরেকে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ অবকাঠামো (রেল ও সড়ক সেতু) দ্রুত সমাপ্তির পথে, তখন বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলতে তারা পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে তাদের পদলেহী ওই দেশের মনুষ্যত্বের লেশবর্জিত (পাকিস্তান আর্মির হুবহু অনুরূপ) সেনাবাহিনী দিয়ে ব্যাপক হত্যা, জখম ও ধর্ষণ দ্বারা অতিষ্ঠ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়েছে। দু’দফায় প্রায় দশ-বারো লাখ মিয়ানমারের শত শত বছর ধরে বসবাসকারী রোহিঙ্গা জনতা এখন বাংলাদেশের ঘাড়ে এসে চেপেছে। সারা পৃথিবীর মানুষ তাদের দুরবস্থা স্বচক্ষে দেখে মিয়ানমার সরকারকে ধিক্কার দেওয়ায় তাদের তারা এখন ফিরিয়ে নিতে মৌখিক নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।

তবে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেওয়ার চেয়েও মিয়ানমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরো ভয়াবহ যে অপরাধটি করছে, সেটি হলো বাংলাদেশে তাদের কারখানায় তৈরি মাদক ইয়াবা পাচার (যেমন- ভারত পাচার করত ফেনসিডিল)। এটা নেশার উপকরণ। যে একবার ধরে সে ছাড়তে পারে না। বাংলাদেশ সরকার অতিবিলম্বে হলেও দেশের ভেতরের ইয়াবা বা মাদক ব্যবসায়ীদের নির্মূল অভিযানে নেমেছে। এতে ইয়াবা ব্যবসা করে রাতারাতি ধনীরা ক্ষুব্ধ। শুধু দেশের ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ধরলে হবে না, ইয়াবার জোগানদার বার্মা বা মিয়ানমার সরকারকেও ধরতে হবে। তাদের দেশের ইয়াবার প্রস্তুতকারক ও সরবরাহকারীদের থামাতে না পারলে মাদক সমস্যার সুরাহা হবে না। ইয়াবা তৈরির কারখানাগুলো আন্তর্জাতিক তদারকিতে ভেঙে দিতে হবে।

বিপদগ্রস্ত ও হতাশ মানুষ নেশা করে তার দুঃখ-বেদনা ক্ষণিকের জন্য ভুলে থাকতে চায়। দেশের যুবারা ও হতাশাগ্রস্তরা বাধ্য হয়ে নেশা করে, তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের চেষ্টা যাতে না করে তার জন্য তাদের অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মেরে ও বাণী প্রচার দিয়ে কিছু হবে না। মনে রাখলে ভালো হবে মানুষ জন্ম থেকে নেশাগ্রস্ত। কেউ বিদ্যা-পাগল, কেউ কাজ-পাগল, কেউ অর্থ-পাগল আর কেউ ইয়াবা, গাঁজা, ভাং ও চরস-পাগল। মাদক ছেড়ে বা ছাড়া কেউ নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads