• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
নারী নির্যাতন : মিথ্যা মামলায় শাস্তির বিধান

আইনের কঠোর বিধানের অপব্যবহার করে হয়রানিমূলক মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে

আর্ট : রাকিব

মতামত

নারী নির্যাতন : মিথ্যা মামলায় শাস্তির বিধান

  • প্রকাশিত ১৩ জুন ২০১৮

দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের কঠোরতাকে পুঁজি করে প্রতিপক্ষকে হয়রানির প্রবণতা উদ্বেগজনক। এ ধরনের মামলা দায়েরের পর তদন্তের জন্য প্রেরণ করা হলে বিস্ময়করভাবে মামলাটি আমলে নেওয়ার সব প্রক্রিয়াই দ্রুত সম্পন্ন হয়ে যায়। আগে থেকেই শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া লোকজন দিয়ে একতরফা জবানবন্দির ব্যবস্থা রয়েছে। ট্রাইব্যুনাল মামলাটি আমলে নিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার আগ পর্যন্ত আসামি জানতেও পারে না যে প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেছে। অথচ অপরাধ প্রমাণিত হলে এ মামলায় তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। তবে তদন্তে এটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে অভিযোগকারীর শাস্তির বিধানও রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা হয়রানির হাত থেকে রেহাই পেতে ওই পথে না গিয়ে অভিযোগকারীর সঙ্গে আপসের পথ খোঁজেন।

কেস স্টাডি : ছোট্ট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী রহিমা খাতুনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে মকবুল হোসেনের (ছদ্মনাম)  ঝগড়া হয়। সামান্য ঝগড়াঝাটির প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে মনগড়া ঘটনা সাজিয়ে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেন রহিমা খাতুন। আদালত বাদিনী রহিমা খাতুনের জবানবন্দি গ্রহণ শেষে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নিকটস্থ থানার ওসির ওপর তদন্ত দেন। ওসি তার তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে, তদন্তকালে বাদিনীর অভিযোগে বর্ণিত ঘটনাটি অর্থাৎ রাত ৯টার সময় তাদের বাড়িতে কোনো প্রকারের ঘটনা ঘটেনি। আসামি মকবুল হোসেন কর্তৃক বাদিনীকে ধর্ষণের চেষ্টার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তদন্তকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, পারিপার্শ্বিকতা ও ঘটনাপ্রবাহে বাদিনীর আনীত ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন/২০০৩) আইনের ৯(৪)(খ) ধারার অভিযোগ প্রাথমিকভাবে সত্য নয় বলে প্রতীয়মান হয়।

এ খবর পেয়ে বাদিনী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন আদালত চত্বরে। এ ঘটনাটি দিয়ে আর কীভাবে মকবুলকে হয়রানি করা যায়, সে বিষয়ে একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। সে মোতাবেক রহিমা খাতুন ওসির তদন্ত প্রতিবেদন সত্য নয় মর্মে আদালতে নারাজি পিটিশন দাখিল করেন। শুরু হয় আদালতপাড়ায় দুই পক্ষের দৌড়ঝাপ। আসামি মকবুল হোসেন খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন নারী ও শিশু নির্যাতনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব মামলার নারাজি পিটিশন মঞ্জুর করা হয়। সহজেই অনুমেয়, নারাজি গ্রহণ করা হলে বিচার প্রক্রিয়ায় পুনঃপ্রবেশ করতে হবে। আসামি মকবুল আইনি ঝামেলা এড়াতে বাদিনীর দালালদের সঙ্গে মামলা তুলে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনায় বসেন। অবশেষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে বাদিনীর সঙ্গে আসামির সমঝোতা হয়। দালালরা টাকা গ্রহণের পর বাদিনীকে বলেন মামলা তুলে নেওয়ার জন্য। সে মতে বাদিনী পরবর্তী তারিখে আদালতে এসে বিচারকের সামনে বলেন, আসামির বিরুদ্ধে তিনি আর নারাজি দাখিল করবেন না। এমনকি আসামির বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগও নেই। যে অভিযোগটি ছিল তা সম্পূর্ণই ভুল বোঝাবুঝিবশত। ব্যস, সব অভিযোগের অবসান ঘটল, মামলাও সমাপ্ত হলো। বলতে গেলে সারা দেশে এ রকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কঠোর বিধানের অপব্যবহার করে হয়রানিমূলক মামলা ঠুকে দেওয়া হচ্ছে।

দেশে ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতনের অপরাধগুলোর কঠোর শাস্তি বিধানের জন্য ১৯৮৩ সালে প্রথম নারী নির্যাতন (নিবর্তক শাস্তি) অধ্যাদেশ নামে একটি আইন জারি করা হয়। পরে ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন নামে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয় এবং এর মাধ্যমে ১৯৮৩ সালের অধ্যাদেশটি রহিত করা হয়। পরে মামলা পরিচালনাকালে এ আইনেরও কিছু সীমাবদ্ধতা, অসঙ্গতি ও ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হওয়ায় ২০০০ সালে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ নামে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন পাস করা হয়। পাশাপাশি ১৯৯৫ সালের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান)’ আইনটি বিলুপ্ত করা হয়। ২০০০ সালের আইনটিই বর্তমানে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের জন্য প্রচলিত আইন হিসেবে বলবৎ আছে। এরপর অবশ্য ২০০৩ সালে আইনটিতে সংশোধনী আনা হয়েছে।

এদিকে ধর্ষণ চেষ্টার মিথ্যা মামলা প্রমাণিত হওয়ায় সম্প্রতি ঢাকার ৫ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল বাদিনী ফিরোজা বেগমকে (ছদ্মনাম) এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে চাচাত বোনের স্বামী গিয়াস উদ্দিন গোপালসহ (ছদ্মনাম) তিনজনের বিরুদ্ধে আনা ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় আদালত এ রায় দেন। কারাদণ্ড ছাড়াও বাদীকে আরো বিশ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক মাসের সাজা দেন আদালত। তবে রায়ের পর ওই নারী আপিলের শর্তে জামিনের প্রার্থনা করলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন।

আদালত সূত্রে জানা যায়, জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরে আসামি ফিরোজা বেগম তার চাচাত বোনের স্বামী গিয়াস উদ্দিন গোপালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেন। পুলিশ ধর্ষণের ঘটনা মিথ্যা মর্মে আদালতে চার্জশিট দাখিল ও মিথ্যা মামলা করায় বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে গিয়াস উদ্দিন গোপাল ওই মামলার বাদী ফিরোজার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারায় মামলা করলে বিচার শেষে বিচারক এ রায় ঘোষণা করেন। এ ধারায় বলা আছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ আইনের অন্য কোনো ধারার অধীন মামলা বা অভিযোগ করার জন্য ন্যায্য বা আইনানুগ কারণ নেই জেনেও মামলা বা অভিযোগ দায়ের করে বা করায় তাহলে মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তি এবং যে অভিযোগ দায়ের করিয়েছে ওই ব্যক্তি অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও হতে পারে। উপধারা (২) মতে, কোনো ব্যক্তির লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনাল উপধারা (১)-এর অধীন সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ ও মামলার বিচার করতে পারবে।

সুতরাং, মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের শিকার হলে বিবাদী আইনের মধ্যে থেকেই আদালতে লিখিত পিটিশন দায়ের করার মধ্য দিয়ে প্রতিকার পেতে পারেন। মিথ্যা মামলা বা অভিযোগের দায়ে অপরাধীর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। নারী নির্যাতন ঠেকাতে উল্লিখিত আইনটি যথার্থভাবে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হোক এবং কোনো নিরপরাধ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হয়- সেটাই সবার প্রত্যাশা।

সিরাজ প্রামাণিক

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

seraj.pramanik@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads