• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম

বাকশাল ছিল জাতীয় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম

  • প্রকাশিত ৩০ জুন ২০১৮

সৈয়দ আবুল হোসেন

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মহানায়ক তিনি। ছিলেন সব শ্রেণির মানুষের নেতা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জনগণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেছেন।

স্বাধীনতার পর তিনি দেশ পুনর্গঠন তথা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়ায় কাজ শুরু করেন। কিন্তু একটি গোষ্ঠী সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ পুনর্গঠনে বাধা সৃষ্টি করে। তাতে স্বাভাবিকভাবে দেশ পরিচালনা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। স্বার্থান্বেষী মহলটি গণতন্ত্র ও দেশের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। দেশি ও বিদেশি শক্তি এত একাট্টা ছিল যে, এদের কঠোরভাবে দমন করতে গেলে একটি সদ্য স্বাধীন দেশের পরিস্থিতি ব্যাপক বিপর্যয়ের মুখে পড়ত। তাই তিনি আজন্ম লালিত স্বপ্ন- গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারাকে পাশ কাটিয়ে সাময়িকভাবে রাজনীতিতে একটি নতুন প্লাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নেন। আওয়ামী লীগসহ সব দলের রাজনীতি বন্ধ করে বাকশাল গঠন করেন। বাকশাল ছিল জাতীয় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ। এটি সব পেশাজীবীর সমন্বয়ে জাতীয় ঐক্যের একটি রাজনৈতিক শক্তি। এর লক্ষ্য ছিল সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা। পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণমুখী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারা প্রবর্তন করা। সবার জন্য সুশাসন, সমতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সর্বোপরি, জনগণের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। সব ষড়যন্ত্র বানচাল করে জাতীয় স্বার্থে সবাইকে সম্পৃক্ত করা।

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সময়ের দাবি পূরণে দেশের ৯০ ভাগ সাংবাদিক বাকশালে যোগদানের আবেদন করেন। এ সময় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে একটি অর্থবহ গণমাধ্যম গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সঙ্গে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলেন। তাদের কাছে কর্মরত সাংবাদিকদের সংখ্যা ও পত্রিকার বিষয়ে জানতে চান। তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের বেতন-ভাতা সম্পর্কে অবহিত হন।

আলোচনায় বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের উন্নয়নের রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক অর্থবহ সংবাদপত্র থাকবে। জাতীয় দৈনিক থাকবে বাংলা এবং ইংরেজিতে। বিভিন্ন পেশার জন্য থাকবে জাতীয় দৈনিক পত্রিকা, যেমন- শ্রমিকের জন্য শ্রমিকবার্তা, কৃষকের জন্য কৃষিবার্তা, শিক্ষাবার্তা ইত্যাদি। প্রতিটি জেলায় নিজস্ব দৈনিক বার্তা থাকবে। দেশের সব পেশা ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি বেতন পাবেন এবং জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের অবারিত প্রবেশাধিকার থাকবে। সংবাদপত্রের পাশাপাশি রেডিও টেলিভিশনের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুলসংখ্যক মেধাবী সাংবাদিকের কথাও আলোচনায় স্থান পায়। সে সময় সাংবাদিক নেতারা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন, ২-৪টি পত্রিকা ছাড়া কোথাও সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন হয় না। এ পরিস্থিতিতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনাকে সাংবাদিক নেতারা স্বাগত জানান। তখন সারা দেশে এক থেকে দেড় হাজার সাংবাদিক কর্মরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক নেতাদের বলেন, নতুন ব্যবস্থায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার সাংবাদিকের প্রয়োজন পড়বে। তিনি এ বিপুলসংখ্যক সাংবাদিককে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করারও আশ্বাস দেন।

এরপর সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে বঙ্গবন্ধু দেশের উন্নয়নে ও জনগণের সত্যিকার খবর প্রাপ্তির জন্য একটি অর্থবহ গণমাধ্যম গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন ‘নিউজ পেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স’ নামে আইন পাস করেন। এ আইনটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি ছিল সাংবাদিক পেশা ও জীবিকার উন্নয়নে একটি কার্যকর পদক্ষেপ। দেশে একটি সত্যিকার ও অর্থবহ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ। সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। মিডিয়া বন্ধের কোনো উপকরণ এতে ছিল না। এটা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও তৎকালীন উন্নয়ন রাজনীতির অবশ্যম্ভাবী একটি পদক্ষেপ। দেশে একটি উন্নয়ন সহযোগী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যয়। যা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। সে সময় এ পদক্ষেপকে সাংবাদিক সমাজ স্বাগত জানিয়েছিল। এতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিক কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন গণমাধ্যমবান্ধব। সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র অফিসের অবস্থান ছিল তার হূদয়ের কাছাকাছি। সাংবাদিকদের মধ্যেও তাঁর অনেক বন্ধু ছিল। তিনি সাংবাদিক তথা গণমাধ্যমের ওপর আস্থা রাখতেন। তার অমর সৃষ্টি প্রথম গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’য় গণমাধ্যমের প্রতি গভীর আগ্রহ ও বিশ্বাসের কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। কেননা বাংলাদেশের সব আন্দোলন-সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অসীম। এ মহান নেতা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পত্রপত্রিকা এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে শুধু ‘সংবাদ মাধ্যম’ না ভেবে ‘গণমাধ্যম’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ওই গ্রন্থগুলোয় তার লেখনীর মাধ্যমে তিনি শুধু গণমাধ্যমই নয়, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের কথা স্মরণ করেছেন গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধাভরে। ভাষা আন্দোলনে গণমাধ্যমের অবদান, ছয় দফা দাবিকে ‘মানুষের বাঁচার দাবি’ হিসেবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের অসামান্য অবদানের কথাও তিনি তার দুটি গ্রন্থে তুলে ধরেছেন চমৎকারভাবে। বঙ্গবন্ধু সারা জীবনই মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে গণমাধ্যমের গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতি, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত’। এরপর তিনি তুলে ধরেন তৎকালীন পূর্ব বাংলার গণমাধ্যম রাজনীতির কথা এবং সেই সময় এ অংশের নেতাদের জনগণের কল্যাণে নেওয়া পদক্ষেপের ইতিহাস। তিনি তার এ দুটি গ্রন্থে তৎকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মালিক ও তাদের ভূমিকা নিয়েও কথা বলেছেন খোলাখুলিভাবে। কখনো কোনো পত্রিকার প্রশংসা করেছেন। কখনো আবার ক্ষেত্রবিশেষে কোনো পত্রিকার ভূমিকাকে নিন্দা করতে ছাড়েননি। তিনি বলেন, ‘চল্লিশের দশকে দৈনিক আজাদ ছিল একমাত্র বাংলা খবরের কাগজ, যা মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত। এ কাগজের প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক মওলানা আকরম খাঁ সাহেব ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। তিনি আবুল হাশিম সাহেবকে দেখতে পারতেন না। আবুল হাশিম সাহেবকে শহীদ সাহেব সমর্থন করতেন বলে মওলানা সাহেব তার ওপর ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমাদেরও ওই একই দশা। তাই আমাদের কোনো সংবাদ ছাপা হতো না। মাঝে মাঝে মোহাম্মাদ মোদাব্বের সাহেবের মারফতে কিছু সংবাদ উঠত। সিরাজুদ্দিন হোসেন এবং আরো দুই-একজন বন্ধু আজাদ অফিসে চাকরি করতেন। তারা ফাঁকে ফাঁকে দুই-একটা সংবাদ ছাপাতেন। দৈনিক মর্নিং নিউজের কথা বাদই দিলাম। ওই পত্রিকা যদিও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত, তবু ওটা একটা গোষ্ঠীর সম্পত্তি ছিল, যাদের শোষক শ্রেণি বলা যায়।... আমরা বুঝতে পারলাম, অন্ততপক্ষে একটা সাপ্তাহিক খবরের কাগজ হলেও আমাদের বের করতে হবে, বিশেষ করে কর্মীদের মধ্যে নতুন ভাবধারা প্রচার করার জন্য।... হাশিম সাহেব শহীদ সাহেবের কাছে প্রস্তাব করলেন কাগজটা প্রকাশ করতে এবং বললেন যে, একবার যে খরচ লাগে, তা পেলে পরে আর জোগাড় করতে অসুবিধা হবে না। নুরুদ্দিন ও আমি এ দুজনই শহীদ সাহেবকে রাজি করতে পারব- এ ধারণা অনেকেরই ছিল। আমরা দুইজন একদিন সময় ঠিক করে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই এবং বুঝিয়ে বলি বেশি টাকা লাগবে না, কারণ সাপ্তাহিক কাগজ। আমাদের মধ্যে ভালো ভালো লেখার হাত আছে, যারা সামান্য হাতখরচ পেলেই কাজ করবে। অনেককে কিছুই না দিলেও চলবে। আরও দুই-একবার দেখা করার পরে শহীদ সাহেব রাজি হলেন। মুসলিম লীগ অফিসের নিচতলায় অনেক খালি ঘর ছিল। তাই জায়গার অসুবিধা হবে না। হাশিম সাহেব নিজেই সম্পাদক হলেন এবং কাগজ বের হলো। আমরা অনেক কর্মীই রাস্তায় হকারি করে কাগজ বিক্রি করতে শুরু করলাম। ...বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে কাগজটা খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করতে লাগল। হিন্দুদের মধ্যেও অনেকে কাগজটা পড়তেন। এর নাম ছিল ‘মিল্লাত’।’

বঙ্গবন্ধু তার রাজনীতির খবরাখবর নিতে ভরসা রাখতেন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর। তিনি তার জীবনের কঠিন সময় বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে। গণমাধ্যম স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে সাহায্য করেছিল, তা-ও তিনি লিখেছেন তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। তিনি বলেন, ‘নওয়াই ওয়াক্ত, পাকিস্তান টাইমস, ইমরোজ ও অন্যান্য কাগজে আমার প্রেস কনফারেন্সের বক্তব্য খুব ভালোভাবে ছাপিয়েছিল। সরকার সমর্থক কাগজগুলো আমার বক্তব্যের বিরুদ্ধে সমালোচনাও করেছিল। আমি রাষ্ট্রভাষা বাংলা, রাজবন্দিদের মুক্তি, গুলি করে হত্যার প্রতিবাদ, স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক সমস্যার ওপর বেশি জোর দিয়েছিলাম।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটি গোষ্ঠী গণমাধ্যমের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দুর্বলতাকে নেতিবাচক খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে। তারা ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন পাস হওয়া ‘নিউজ পেপার ডিক্লারেশন এনালমেন্ট অর্ডিন্যান্স’ নামে আইনটির কঠোর সমালোচনা করতে শুরু করে। অথচ আইনটি করা হয়েছিল সাংবাদিক নেতাদের পরামর্শে। এর আগে পর্যন্ত সাংবাদিকদের কোনো বেতন কাঠামো ছিল না। মালিকরা সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন দিতেন না। এরপরও যা দিতেন তা দিয়ে একজনেরও চলা কষ্ট ছিল। বঙ্গবন্ধু এসব জানতেন। তাই তিনি সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন-ভাতা পাওয়া নিশ্চিত করেছিলেন। ’৭৫ সালের ১৬ জুনের পর যেসব পত্রিকা বন্ধ করা হয় তিনি সেসব সাংবাদিক-কর্মচারীর বেতন নিশ্চিত করেছিলেন। তারা এক তারিখ ট্রেজারিতে গিয়ে বেতন নিয়ে আসতেন। অথচ তার মৃত্যুর পর সুবিধাবাদী সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর বাকশালসহ বঙ্গবন্ধুর গণমাধ্যম নীতির সমালোচনা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালান। এতে তারা সাময়িক সফলও হয়েছেন। তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সংবাদপত্র বন্ধের অপবাদ দিয়েছেন। সাংবাদিকদের চাকরিচ্যুত করার অপবাদ দিয়েছেন। সংবাদপত্র ধ্বংসের কথা বলেছেন। কিন্তু এ অপবাদের কোনোটাই সত্য নয়, তথ্যভিত্তিক নয়। শুধু বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা- যেটা আজ প্রমাণিত।

লেখক : রাজনীতিবিদ, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads