• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯
সৌদি নারীর যাপিত জীবনে পরিবর্তনের সুবাতাস

সৌদি আরবের বেশিরভাগ নারীর মাধ্যমিক শিক্ষার পরপরই বিয়ে হয়ে যায়

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

সৌদি নারীর যাপিত জীবনে পরিবর্তনের সুবাতাস

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ০৮ জুলাই ২০১৮

সৌদি আরবের মেয়েদের জীবন যেন এক অন্ধকার অমানিশা। সেখানে মানবাধিকার পরিস্থিতি বড্ড নাজুক। নারী অধিকার খুবই সীমিত। আইনে নিষিদ্ধ নয় এমন কাজও তারা করতে পারে না সামাজিক গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে। নারী গাড়ি চালাতে পারবে না- এমন কোনো আইন নেই সৌদি আরবে। তা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে নারীকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল।

সৌদি আরবের বেশিরভাগ নারীর মাধ্যমিক শিক্ষার পরপরই বিয়ে হয়ে যায়। বাকস্বাধীনতা ও নারী অধিকার প্রশ্নে তাই সদা সমালোচিত সৌদি আরব। সম্প্রতি ‘দিনা আলী’ নামে এক সৌদি তরুণীকে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সেই বিয়েতে সায় ছিল না দিনার। তাই বাঁচার জন্য পালিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সময় গ্রেফতার হন তিনি। এ ঘটনায় বিশ্বব্যাপী আলোচনা ও নিন্দার ঝড় ওঠে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো আশঙ্কা করছে, তার জীবনের হুমকি রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’কে প্রত্যক্ষদর্শী এক কানাডিয়ান নাগরিক জানিয়েছেন, ২৪ বছর বয়সী দিনা আলী লাসলুমকে ১১ এপ্রিল ম্যানিলা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সিডনিগামী ফ্লাইটে উঠতে দেয়নি। তারা বিমানবন্দরে তাকে আটকে দেয়। এরপর জোরপূর্বক তাকে দেশে পাঠায়। যদিও দিনা আশঙ্কা করছিলেন তাকে দেশে পাঠালে মেরে ফেলা হতে পারে। ওই নারী জানান, বিমানবন্দরে দিনা তাকে জানিয়েছিলেন, তার পাসপোর্ট ও বোর্ডিংপাস বাজেয়াফত করা হয়েছে। তিনি তখন দিনাকে নিয়ে কয়েকটি ভিডিও বানিয়েছিলেন, যাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে সাহায্য করার আবেদন জানাতে পারেন। এর একটি ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দিনা বলেছেন, ‘আমার পরিবার যদি আসে তারা আমাকে হত্যা করবে। সৌদি আরবে গেলে আমি মারা যাব। দয়া করে আমাকে সাহায্য কর। আমাকে একজন অপরাধী হিসেবে এখানে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমার কিছু করার নেই।’ বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীদের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, দিনাকে যখন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন। পরে ডাক্ট টেপ দিয়ে তার মুখ ও হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছিল।

বর্তমান বিশ্বকে আমরা বলি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর বিশ্বায়নের কারণে সারা বিশ্ব এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। মেয়েরা জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে পুরুষের পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে সমান তালে। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির এই অভাবনীয় সাফল্যের যুগেও সৌদি আরবে চলছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী, সে বিয়ে করতে চায় না; অথচ তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হবে, টেনেহিঁচড়ে তাকে সেখানেই পাঠানো হবে যেখানে তার বিয়ের কথা হচ্ছিল— এ কেমন ব্যবস্থা!

সৌদি আরবে ‘পুরুষ অভিভাবক আইন’ নামে একটি জগদ্দল আইন আছে। এই আইনের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছিলেন দিনা আলী। এই আইন অনুযায়ী নারীর পড়াশোনা, বিয়ে, চাকরি সব ঠিক করবে পুরুষ। সে নারী প্রাপ্তবয়স্ক হোক আর যাই-ই হোক। সৌদি আইনের দৃষ্টিতে সে নাবালক। তার অভিভাবক কোনো একজন পুরুষ। নারীর বিদেশ ভ্রমণের জন্য পাসপোর্ট করতেও লাগবে পরিবারের পুরুষের অনুমতি। কোনো নারী হয়ত পড়তে চায় নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো একটি সাবজেক্ট- এটা নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। কিন্তু পুরুষ অভিভাবকের সিদ্ধান্তে তাকে পড়তে হবে অন্য সাবজেক্ট। সে হয়ত কাউকে ভালোবেসেছে, তাকে নিয়ে তার ঘর বাঁধার স্বপ্ন কিংবা স্বামী হিসেবে তার পছন্দের একটা মাপকাঠি আছে। কিন্তু সেই অনুযায়ী বিয়ে করার কোনো স্বাধীনতা তার নেই। তাকে হয়ত বিয়ে করতে হবে এমন একজনকে যাকে সে কখনই দেখেনি বা যাকে তার একেবারেই অপছন্দ। পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও একই অবস্থা। সে হয়ত পরতে চায় আধুনিক পোশাক-আশাক, অথচ তাকে পরতে হবে আবায়া, বোরকা, হিজাব। তা সে পছন্দ করুক আর না-ই করুক।

সৌদি আরবে বহুবিবাহ ও ডিভোর্সের হার অনেক। তাই সৌদি নারীরা বিয়ের ক্ষেত্রে বিদেশি পুরুষ বেশি পছন্দ করে। তা ছাড়াও তারা চায় সৌদি আরবের নারী অবান্ধব পরিবেশের বাইরে গিয়ে মানসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ভোগ করতে। উপসাগরীয় দেশের মধ্যে কুয়েতের পুরুষ বেশি বিয়ে করছে ও করেছে তারা, এই তালিকায় আছে ইয়েমেনও। অনারব বিয়ে করার ব্যাপারে সামাজিক টাবু থাকা সত্ত্বেও আনুমানিক ১১৮ সৌদি নারী পাকিস্তানি বিয়ে করেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সৌদি নারীদের বিদেশি বিয়ে করার হার ১০ শতাংশ। কিন্তু বিয়ে করলেও নাগরিকত্ব নিয়ে সমস্যা হয়। এটাও সৌদি নারীদের জন্য এক ধরনের নির্যাতন।

অথচ সৌদি পুরুষদের কথা তো আমাদের জানাই আছে। বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নেয় সৌদি আরব। সৌদি পুরুষের শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানির কারণে বাংলাদেশি নারীরা পালিয়ে যায়। নারীদের এই পলায়নের হার এত বেশি যে, সৌদি আরবস্থ বাংলাদেশের কূটনীতিকদের ‘সেফহোম’ খুলতে হয়েছে। সৌদি আরবস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের ফাঁস হওয়া এক নথিতে এসব তথ্য পাওয়া গেছে বলে ‘মিডল ইস্ট আই’ অনলাইনের এক বক্তব্যে বলা হয়েছে। ২০১৫ সালে লেখা ওই মেমোতে বলা হয়েছে, গড়ে প্রতিদিন তিন থেকে চারজন গৃহকর্মী আশ্রয় নিতে আসেন। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী জেদ্দা ও রিয়াদে অন্তত ২৫০ নারী আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলেন।

এক পরিবারের কর্তা ও সাত ছেলে মিলে গৃহকর্মীদের দিনের পর দিন ধর্ষণের ঘটনাও সৌদি আরবে ঘটেছে একাধিক। গৃহকর্মীরা প্রতিবাদ করলে তাদের মারাত্মকভাবে আঘাত করা হয়। এমনকি খুন্তি পুড়িয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছ্যাঁকাও দেওয়া হয়। নারীদের আঘাত করার জন্য সৌদি পুরুষের পছন্দের জায়গা নারীর তলপেট। তলপেটে আঘাত করায় গৃহকর্মীদের একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অথচ এই নিম্নবিত্ত নারীরা কত স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন। বিদেশে যাওয়ার সময় তাদের বলা হয়েছিল, পরিবারের ছোট একটি বা দুটি শিশুর দেখাশোনা করতে হবে, সঙ্গে করতে হবে সংসারের টুকিটাকি কাজ। বিনিময়ে মোটা বেতন। কত আশা ছিল টাকা জমিয়ে দেশে ফিরে তারা জমি কিনবেন, ঘর বানাবেন। অথচ এক ফুৎকারে শেষ হয়ে গেল অধিকাংশ নারীর সেই স্বপ্ন। এই নারীরা পালিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গেলেও দেশে ফেরা তাদের জন্য দুরূহ হয়ে যায়। কারণ তাদের অধিকাংশের হাতেই পাসপোর্ট থাকে না। পাসপোর্ট হয় সৌদি গৃহস্বামী নতুবা রিক্রুটিং এজেন্সি আটক করে রাখে, যাতে তারা পালিয়ে দেশে ফিরতে না পারেন।

এই যখন সৌদি আরবের পুরুষের চারিত্রির বয়ান, সেখানে নারীদের ওপর অত্যাচার করে তারা কোন মুখে! এক নারী ভোগে যেখানে বাপ-বেটার বাছবিচার নেই, সেখানে আবার নারী শাসন। এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে!

অনেক মুসলিম দেশে মেয়েরা বৈমানিক হয়েছে। অথচ সৌদি নারীর গাড়ি চালানো নিয়েও সমস্যা ছিল, যা আগেই উল্লেখ করেছি। অধিকাংশ পুরুষ মনে করত, নারী গাড়ি চালানো শুরু করলে সব সামাজিক বিধিনিষেধ অমান্য করবে। ২০১১ সালে একটি নারী সংগঠন ‘উইমেন ড্রাইভিং’ নামে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন শুরু করে। সৌদি আরব শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুরা আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০১৪ সালে মেয়েদের শারীরিক শিক্ষার অনুমোদন দিলেও শুরা কাউন্সিলের অনুমোদনের পর ধর্মগুরুরা পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ বলে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল। ফলে কার্যকর হয়নি তখন। সৌদি নারীরা দীর্ঘদিন ধরে কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়নি। ২০১২ সালে দুজন নারী ক্রীড়াবিদ অলিম্পিকে অংশ নেয়। ২০১৪ সালে অংশ নেয় চারজন।

বেশ কিছু নারী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে নারী অধিকার প্রশ্নে সোচ্চার ছিল। এর একটি ‘ও ইয়াহেজা আর হুইয়াইদ এবং ফাওযিয়া আর এউয়ানি’ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। ২০১৮ সালে সংগঠনটি ‘নারী নির্যাতনকে না বলুন’ নামে প্রচারণা শুরু করে। এরা নারীদের অত্যাচার ও নির্যাতনের কাহিনি রেকর্ড করা শুরু করে। এই সংগঠনটি সরকারিভাবে নিবন্ধিত নয়। তাদের প্রকাশ্য সভা করার ব্যাপারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা আছে। সৌদি মেয়েরাও দিনে দিনে সচেতন হয়ে ওঠে। তারাও নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে কথা বলতে শুরু করে। ‘স্টপ এনস্ল্যাবিং সৌদি উইমেন’, ‘সৌদি নারীদের ক্রীতদাসী করা বন্ধ কর’ নামে প্রচারণা টুইটারে হ্যাশট্যাগ করে ছড়িয়ে দিতে থাকে তারা। তারা বলতে থাকে, ‘তারাও মানুষ। একজন সৌদি নাগরিকের যা যা অধিকার আছে তা তাদেরও আছে।’

সৌদি নারীদের দীর্ঘদিনের এই বদ্ধ অবস্থার অবসান হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উদ্যোগে কতগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে-

১. নারীর গাড়ি চালানোর অনুমতি প্রদান

২. সেনাবাহিনীতে যোগদান

৩. আবায়া পরার বাধ্যবাধকতা তুলে ফেলা

৪. সিনেমা চালু করা

৫. রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতি সংস্কার।

প্রথম পদক্ষেপটি ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। জুন মাস থেকে সৌদি নারীরা গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছে। গাড়ি চালানোর নিষেধাজ্ঞা তোলামাত্র ওদিন মাঝরাতেই নারীরা নেমে পড়লেন গাড়ি নিয়ে। চলল উল্লাস। আনন্দে ‘ভি চিহ্ন’ দেখালেন দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ নারীরা। সেলফি তুলতে লাগলেন। এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন তারা বহু বছর। সাক্ষী হলো সারা বিশ্ব।

বেশকিছু নারী ড্রাইভিংয়ের লাইসেন্স পেয়েছে। তবে পুরুষরা নাকি সৌদি নারীদের গাড়ি চালানো নিয়ে টিটকারি দিচ্ছে। অবশ্য এর উল্টো দিকও আছে। একজন ইমামকে ইতোমধ্যে ধর্মপ্রচার থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শেখ সাহ আল হাজারী নামে এই ইমাম সৌদি আরবের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত আসিরা অঞ্চলের ধর্মীয় প্রধান। তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েরা বোকা। গাড়ি চালানোর মতো পর্যাপ্ত বুদ্ধি তাদের মাথায় নেই। এমনিতেই মেয়েদের মাথায় বুদ্ধি পুরুষের ৫০ ভাগ আর কেনাকাটার পর এই বুদ্ধি নেমে আসে ২৫-এ। একটা আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলার পর তা ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়। ফলে আসিরা অঞ্চলের গভর্নর তাকে সব ধরনের ধর্মীয় প্রচার থেকে অব্যাহতি দেন।

নিঃসন্দেহে এটি একটি শুভ উদ্যোগ। আমরা আশা করব, সৌদি পুরুষের নারীবিদ্বেষী মানসিকতার পরিবর্তন হবে। আর রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতি বিশেষ করে ‘পুরুষ অভিভাবকত্ব’ আইনের মতো নারী বিধ্বংসী আইনের পরিবর্তন হবে। এখন কবে এই সংস্কার হবে, সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি আমরা।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, কলাম লেখক, সাবেক যুগ্ম সচিব

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads