• শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪২৯
শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ৩০ বছর

জাতিসংঘের ৫৬টি শান্তিরক্ষা মিশনের মধ্যে বাংলাদেশ ৫৪টি মিশনেই অংশ নিয়েছে

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ৩০ বছর

  • প্রকাশিত ১০ জুলাই ২০১৮

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী ৩০ বছর পার করেছে। বিশ্বের সংঘাতকবলিত বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সৈনিকদের গৌরবময় ঐতিহ্য রয়েছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী জাতিসংঘের ৫৬ মিশনের ৫৪টিতেই অংশগ্রহণ করছে। গত ৩০ বছরে দায়িত্ব পালনকারী সেনাসংখ্যা ১ লাখ ৩২ হাজার ৬১৮ জন। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১৩২ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, তারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেছেন।

১৯৮৮ সালের ১৮ আগস্ট জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকা কুয়েত এয়ারওয়াজের একটি যাত্রীবাহী বিমানে একে একে উঠেছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৫ জন অফিসার। অফিসারদের এই বিদায় পর্বটি অত্যন্ত আবেগঘন ছিল। যে কাজে তারা যাচ্ছেন, সেটার ধরন সম্পর্কে কারোরই পূর্বধারণা ছিল না। কেননা দেশের সীমানার বাইরে এ ধরনের দায়িত্ব এর আগে কখনো পালন করেননি বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর কোনো সেনাসদস্য। প্রথম শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়া এই কর্মকর্তারা যোগ দিয়েছিলেন নিরস্ত্র পর্যবেক্ষক হিসেবে। পরবর্তী ৩০ বছরে একে একে বাংলাদেশের ১ লাখ ৩২ হাজার ৬১৮ সেনাসদস্য ৪০টি দেশে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে (আগস্ট ২০০৭ পর্যন্ত) ১২৪টি দেশের ৯৫ হাজার ৪৬৭ জন শান্তিরক্ষী ১২টি মিশনে নিয়োজিত আছেন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আছে ৭ হাজার ৬৩৬ জন (পুলিশসহ) শান্তিরক্ষী। একক দেশের সংখ্যার দিক দিয়ে এটি দ্বিতীয় সর্বাধিক। ইথিওপিয়া বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ৫৫০ জন বেশি শান্তিরক্ষী নিয়োজিত করে তালিকার শীর্ষে আছে। এর আগে বিশেষত ২০০৭-০৮ সাল থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রায় পুরো সময়জুড়ে এ তালিকার শীর্ষে ছিল। সে সময় সেনাবাহিনী থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০ হাজার শান্তিরক্ষী নিয়োজিত হয়েছিল। গত ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ সালে সেনাবাহিনী থেকে যথাক্রমে ৬ হাজার ৮৯ ও ৫ হাজার ৯১২ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত ছিলেন।

জাতিসংঘের ৫৬টি শান্তিরক্ষা মিশনের মধ্যে বাংলাদেশ ৫৪টি মিশনেই অংশ নিয়েছে বা নিয়োজিত আছে। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ১৯৮৯ সাল থেকে পুলিশ এবং ১৯৯৩ থেকে নৌ ও বিমানবাহিনীও শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে আসছে।

শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের জন্য অতিরিক্ত কিছু যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এ কারণে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগের আগে এবং দায়িত্বরত অবস্থায় বেশকিছু প্রশিক্ষণ নিতে হয়। বিশেষত সামরিক কর্মকর্তাদের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। দেশে শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন  ট্রেনিং (বিপসট) নামে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। এই প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শান্তিরক্ষীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন।

শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণের ফলে বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, একই সঙ্গে শন্তিরক্ষা মিশন থেকে সরকার বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাও আয় করছে। বর্তমান সরকারের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এটি একটি অন্যতম প্রধান উৎস।

অশান্ত ও বিরোধপূর্ণ এলাকায় শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আজকের এই উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তৈরিতে শান্তিরক্ষীদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। বৈরী আবহাওয়া, অচেনা পরিবেশ এবং নির্বান্ধব এলাকায় দুষ্কৃতিকারী বা বৈরী পক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়। বিবদমান পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যে হানাহানি বা মারামারি শুরু করলে শান্তিরক্ষীদের তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে হয়। এতে কখনো কখনো জীবনহানি ঘটে। শান্তি নিশ্চিত করতে গিয়ে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ১১৫ জন শান্তিরক্ষী জীবন দিয়েছেন।

শান্তিরক্ষীদের মধ্যে যারা নিরস্ত্র এবং ব্যক্তি হিসেবে মিশন এলাকায় নিয়োজিত, তারা জাতিসংঘের কাছ থেকে সরাসরি তাদের জন্য প্রযোজ্য আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে সমষ্টিগতভাবে শান্তিরক্ষীদের জন্য প্রযোজ্য আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারকে দেয়। বাংলাদেশ সরকার পরে নিজস্ব নিয়মে শান্তিরক্ষীদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করে। একটি সরকারি সূত্রে জানা যায়, ২০০১-১০ সময়কালে বাংলাদেশ সরকার সৈনিক নিয়োগ, কন্টিনজেন্টের নিজস্ব দ্রব্যসামগ্রী এবং অন্যান্য ধরনের ক্ষতিপূরণের জন্য জাতিসংঘ থেকে ১ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ২০১১-১২ সালে জাতিসংঘ শুধু দ্রব্যসামগ্রীর জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ৪৭ কোটি ৮৪ লাখ ৮২ হাজার ৪০২ মার্কিন ডলার দেয় (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, পঞ্চম খণ্ড। মে, ২০১৫। পৃষ্ঠা ৪১৩)।

বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্বের কারণে ১৯৮৮-পরবর্তী সময়ে প্রায় সবকয়টি মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যরা নিজেদের অপরিহার্য করে তুলেছেন। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও কর্মকাণ্ড, মানবিক গুণাবলি, শৃঙ্খলা ও স্থানীয় জনগণের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা (সূত্র : বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস, পঞ্চম খণ্ড)।

শান্তিরক্ষা মিশনে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণে দেশের সুনাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে দেশও উন্নত হচ্ছে। আমরা প্রত্যাশা করব, সামরিক বাহিনী দেশের স্বার্থে আরো বেশি করে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে অবদান রাখবে।

আ. ব. ম. রবিউল ইসলাম

কলেজ শিক্ষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads