• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯
ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র

সর্বশেষ দৃশ্যপটে আনা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাতি রাহুল গান্ধীকে

ছবি : ইন্টারনেট

মতামত

ভারতীয় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ১৮ জুলাই ২০১৮

তিন দিক থেকে ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটা প্রধান পরিচয় হলো সে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। তাই ভারতের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে অনেকের মতো আমার নিজেরও যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। সব বাংলাদেশিরই সম্ভবত এই আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক।

এভাবে শুরু করার বিশেষ কারণ রয়েছে। পাঠকদের মনে পড়তে পারে, গত ২৩ মে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধে ইতিহাস পর্যালোচনার ভিত্তিতে মূলকথায় বলেছিলাম, বাংলাদেশের শুধু নয়, ভারত ও পাকিস্তানসহ এই উপমহাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, ‘একজন’ প্রধান নেতা বা নেত্রীকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলের বিকাশ ঘটে এবং দলের সর্বময় ক্ষমতা চলে যায় ওই নেতা বা নেত্রীর হাতে। তার বক্তব্যই দলের বক্তব্য হয় এবং তার ইচ্ছায় দলের ভেতরে পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটিশ ভারতে এ বৈশিষ্ট্যের সূচনা ও বিকাশ ঘটেছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে সামনে রেখে। স্বাধীন ভারতে নেতৃত্বের সে ধারাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। ভারতে এখনো নেতানির্ভর দলীয় বৈশিষ্ট্য সক্রিয় রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ দৃশ্যপটে আনা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নাতি রাহুল গান্ধীকে। রাহুলের পিতা রাজীব গান্ধীও মা ও নানার মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। গত বছর ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর রাহুল গান্ধীকে ভারতের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি ঘোষণা করা হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর তাকে সভাপতির দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন দলের সেদিন পর্যন্ত সভাপতি এবং রাহুল গান্ধীর মা সোনিয়া গান্ধী। দীর্ঘ ১৯ বছর পর নিজের ছেলে রাহুল গান্ধীকে পদটিতে বসিয়ে সোনিয়া গান্ধী সরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।

১৩২ বছরের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি সময় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন থাকলেও ২০১৪ সালের পর থেকে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ে দলটি। সে বছর অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানও অর্জন করতে পারেনি। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে যখন অনিচ্ছুক ও রাজনীতিতে অপরিপক্ব সোনিয়া গান্ধীকে সভাপতি বানানো হয়েছিল, কংগ্রেস তখন চারটি মাত্র ক্ষুদ্র ও কম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল। বিজেপি নেতা প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স-এনডিএ জোটের প্রচণ্ড দাপটের বিরুদ্ধে রীতিমতো লড়াই করেছিলেন সোনিয়া গান্ধী। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সোনিয়ার নেতৃত্বে কংগ্রেস বিরাট বিজয় অর্জন করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। ২০০৯ সালের নির্বাচনেও কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত ইউনাইটেড পিপলস অ্যালায়েন্স বা ইউপিএ জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করেছিল। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় কংগ্রেস একাই জিতেছিল ২০৬টি আসনে। সেবার সোনিয়া গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি উঠেছিল জোরেশোরে। কিন্তু বিজেপির কঠোর বিরোধিতার মুখে সোনিয়া গান্ধী পিছু হটেছিলেন। যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলেছিলেন, তার ‘অন্তরাত্মা’ নাকি তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে নিষেধ করেছে!

নিজে সরে গিয়ে সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্তি দিয়েছিলেন ড. মনমোহন সিংকে। কিন্তু ইউপিএ তথা কংগ্রেস সরকার ক্রমাগত ব্যর্থতার নজির স্থাপন করেছে। একযোগে শুরু হয়েছিল কংগ্রেসের পতন। সেই সুযোগে দ্রুত সাফল্যের পথে এগিয়ে এসেছিল বিজেপি। হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেসের ব্যর্থতার কারণে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একাই জিতেছিল ২৮২টি আসনে। অন্যদিকে কংগ্রেস এমনকি প্রধান বিরোধী দলের অবস্থানেও যেতে পারেনি। কেন্দ্রে শুধু নয়, রাজ্যগুলোতেও কংগ্রেস ক্ষমতায় আসতে পারেনি। বরং বেশকিছু রাজ্যে দলটি ক্ষমতা হারিয়েছিল। কংগ্রেস একই সঙ্গে প্রধান দলের অবস্থানও খুইয়ে ফেলেছে। 

দলের এমন এক শোচনীয় অবস্থায় রাহুল গান্ধীর মতো মাত্র ৪৮ বছর বয়সী একজন তরুণ নেতাকে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত করায় ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রতিক্রিয়ার একটি বড় কারণ হলো, ভারত এখনো ‘মোদি জোয়ারে’ ভেসে চলেছে। এ সময়ে বিজেপির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য কংগ্রেসের নেতৃত্বে এমন একজনের প্রয়োজন ছিল যার সঙ্গে কাজ করতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবের মতো প্রবীণ নেতারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন। বিজেপি বিরোধী প্রধান জোট ইউপিএর নেতৃত্বও যেহেতু কংগ্রেসের হাতেই রয়েছে ও থাকবে সেহেতু দলটির সভাপতি পদে প্রবীণ কাউকেই আশা করেছিল জোটভুক্ত দলগুলো। এতদিন সোনিয়া গান্ধী ইউপিএর নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার স্থলে রাহুল গান্ধী কতটা গ্রহণযোগ্য হবেন তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, সংশয়ও রয়েছে তার নিজের যোগ্যতা নিয়ে।

এ ধরনের প্রশ্ন ও সংশয় থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসের সভাপতি পদে রাহুল গান্ধীর নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টিকে ইতিহাসের আলোকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে। কারণ, তিনি ‘গান্ধী পরিবারের’ সদস্য এবং সভাপতির পদে এ পর্যন্ত যে ১৫ জন বসেছেন তাদের মধ্যে ওই একটি পরিবার থেকেই এসেছেন পাঁচজন। রাহুল গান্ধী ষষ্ঠ সদস্য। উল্লেখ্য, ‘গান্ধী পরিবারের’ পক্ষে নেতৃত্বের সূচনা করেছিলেন পণ্ডিত মতিলাল নেহরু। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পিতা মতিলাল নেহরু ১৯১৯ থেকে ১৯২০ এবং ১৯২৮ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত দুই দফায় কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকা জওহরলাল নেহরু কয়েক দফায় কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। নেহরুর কন্যা ও পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে আলোচিত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৬ সাল থেকে এবং ইন্দিরার ছেলে রাজীব গান্ধী ১৯৮৪ সাল থেকে আট বছর কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন।

এরপর কিছুদিন কংগ্রেস ছিল নরসীমা রাও ও সীতারাম কেশরীর নেতৃত্বে। এই দু’জনের পর ১৯৯৮ সালে আগত সোনিয়া গান্ধী এক নাগাড়ে ১৯ বছর সভাপতি পদে থেকে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এ সময়ের মধ্যে নিজের ‘অন্তরাত্মা’র ডাকে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী না হলেও তিনি কংগ্রেসকে দু’বার কেন্দ্রের ক্ষমতায় এনেছেন। একই ‘গান্ধী পরিবারের’ সদস্য হওয়ায় রাহুল গান্ধীকে নিয়ে কংগ্রেসের ভেতরে কোনো দ্বিধা বা বিরোধিতা লক্ষ করা যায়নি। বরং দলের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তাকে কংগ্রেসের ‘ডার্লিং বয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেস আবারো কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হবে। আরো অনেকেও একই রকম আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও রাহুল গান্ধীকে স্বাগত জানিয়ে এক টুইটার বার্তায় বলেছেন, তিনি তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর ‘ফলপ্রসূ কার্যকাল’ কামনা করছেন!

অন্যদিকে রাহুল গান্ধী কিন্তু তার প্রথম ভাষণেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে অত্যন্ত আক্রমণাত্মক বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকে এতদিন কংগ্রেস যা কিছু গড়েছে বিজেপি সে সবের কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি, বরং সবকিছু ভেঙে ফেলেছে। শুধু তা-ই নয়, কংগ্রেস ভারতকে একুশ শতকে নিয়ে যেতে চায় আর বিজেপি নাকি চায় মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিতে। অনেকাংশে কবিতা আবৃত্তির ঢঙে রাহুল গান্ধী বলেছেন, ওরা আগুন লাগায়, আমরা আগুন নেভাই। ওরা ভাঙে আর আমরা গড়ি। ওরা ক্রোধ দেখায় আর আমরা ভালোবাসি। এসবই নাকি বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের পার্থক্য।

রাহুল গান্ধীর এ ধরনের আক্রমণাত্মক বক্তব্যে কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলেছেন, কংগ্রেসের জন্য ‘ভদ্র’ ইমেজের সোনিয়া গান্ধীর স্থলে মারমুখী রাহুলেরই দরকার ছিল। অন্যদিকে বিজেপি নেতারা কটাক্ষ করে বলেছেন, প্রজন্মের বদল হয়েছে সত্য কিন্তু কংগ্রেসের নীতি ও মানসিকতা বদলায়নি।

রাহুল গান্ধীকে নিয়ে কংগ্রেস ও বিজেপির পাশাপাশি সাধারণভাবে ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে যথেষ্ট আলোড়ন উঠলেও একজন নেতা হিসেবে তিনি কিন্তু এখনো তেমন সাফল্য দেখাতে পারেননি। বিগত দুটি লোকসভা নির্বাচনেই সোনিয়া গান্ধী অঘোষিতভাবে রাহুল গান্ধীকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বেশ কয়েকটি রাজ্যসভার নির্বাচনের সময়ও রাহুল গান্ধীকেই প্রধান নেতার ভূমিকায় দেখা গেছে। কিন্তু কোনো নির্বাচনেই তিনি কংগ্রেসের ভরাডুবি ঠেকাতে পারেননি। যেমন চলতি বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত ত্রিপুরার নির্বাচনে দলটির ভোট আগেরবারের ৪২ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে মাত্র এক দশমিক আট শতাংশে। অন্যদিকে ঠিক উল্টোটি ঘটেছে বিজেপির ক্ষেত্রে। আগেরবারের পাওয়া এক দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে এক লাফে বেড়ে বিজেপি এবার পেয়েছে ৪৩ শতাংশ ভোট। আরেক রাজ্য কর্নাটকে রাহুল গান্ধী অবশ্য সাফল্য দেখিয়েছেন। মে মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত বিধান সভার নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। এই সুযোগে তৃতীয় দল জেডিএসের সঙ্গে যৌথভাবে ক্ষমতায় গেছে কংগ্রেস। কিন্তু এজন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদটি দিতে হয়েছে জেডিএসের এইচ ডি কুমারস্বামীকে।

এভাবেই সাফল্য ও ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে রাহুল গান্ধীর যাত্রা শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে তিনি কতটা কার্যকরভাবে জনমত গঠন করতে পারেন এবং তার নেতৃত্বে কংগ্রেস ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে পারে কি না— এসবের ওপর শুধু কংগ্রেসের নয়, রাহুল গান্ধীর নিজের ভবিষ্যৎও নির্ভর করছে। কারণ, একটি মাত্র ‘যোগ্যতার’ বলেই রাহুল কংগ্রেসের মতো সবচেয়ে প্রাচীন দলের সভাপতি হতে পেরেছেন— তিনি ‘গান্ধী পরিবারের’ সদস্য। এর মধ্য দিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে, ন্যাশনাল কংগ্রেস অন্তত পরিবারতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মতো ভারতেও এখনো ‘একজন’ নেতাকেন্দ্রিক দলের বিকাশের তত্ত্বটিই সত্য।

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads