• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯
বাঘ সংরক্ষণের প্রশংসনীয় উদ্যোগ

শুধু সুন্দরবনেই নয়, সারা বিশ্বেই বাঘের সংখ্যা অপ্রতুল্য

সংরক্ষিত ছবি

মতামত

বাঘ সংরক্ষণের প্রশংসনীয় উদ্যোগ

  • প্রকাশিত ১৯ জুলাই ২০১৮

সুন্দরবন অঞ্চলে বাঘ এ পর্যন্ত যত মানুষকে আক্রমণ বা হত্যা করেছে তাদের বেশিরভাগই বাওয়ালি, মৌয়াল, জেলেসহ বিভিন্ন ধরনের শিকারি কিংবা চোরাকারবারি। খুব কমই আক্রান্ত হয়েছেন পর্যটক। কারণ, পর্যটকদের প্রতি আগে থেকেই সতর্কতার নোটিশ দেওয়া থাকে কর্তৃপক্ষের।

অপরদিকে পেশাজীবী কিংবা চোরাকারবারিদের চলাফেরায় থাকে বেপরোয়া গতি, ফলে যেকোনো মুহূর্তে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। যে মানুষটি একবার রয়েল বেঙ্গলের মুখোমুখি হয়েছেন সে মানুষটি বেঁচে ফিরে এসেছেন খুব কমই। এলেও মৃতপ্রায় হয়ে ফিরে এসেছেন কিংবা বিকৃত চেহারা নিয়ে ফিরেছেন।

এক সমীক্ষায় জানা যায়, স্বভাবে সুন্দরবনের বাঘ শুধু হিংস্রই নয়; উগ্রহিংস্র। ওদের এ হিংস্রতাই শাপেবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্যটি আজ অবধি টিকে রয়েছে শুধু রয়েল বেঙ্গলের হিংস্রতার কারণে। তাই সাধুবাদ জানাতে হয় এ অতন্দ্র প্রহরীকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যে অতন্দ্র প্রহরী নিজ দায়িত্বে সুন্দরবন রক্ষা করছে সে প্রাণীটি নিজেকে এবং তার শাবককে রক্ষা করতে পারছে না চোরাকারবারিদের কবল থেকে। চোরাকারবারিরা বিভিন্ন কৌশলে পরাস্ত করে প্রাণ কেড়ে নিয়ে ওদের চামড়া ছিলে হাড়গোড় সংগ্রহ করে পাচারের উদ্দেশ্যে লোকালয়ে নিয়ে আসে। অতঃপর রাজধানী হয়ে চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে চলে যায়। লোভের বশবর্তী হয়ে চোরাকারবারিরা বাঘের পেছনে লেগেই থাকে। লগ্নিও করে প্রচুর অর্থকড়ি।

এমন ঘটনা বার বার সুন্দরবন অঞ্চলে ঘটেছে, যার প্রমাণও রয়েছে। সবশেষ ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি এমন ঘটনা ঘটিয়েছে চোরাকারবারিরা। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় র্যাব-৮-এর সদস্যরা চোরাকারবারিদের ধরতে সক্ষমও হয়েছেন। সেই সঙ্গে উদ্ধার করেছেন ৯ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা একটি বাঘের চামড়া, ২৪ খণ্ড হাড়, ২৯টি দাঁত এবং একটি মাথা। দুঃসংবাদটি জানতে পেরে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়েছি তখন। যে মুহূর্তে বাঘ শুমারির কাজ চলছিল ঠিক তখনি বাঘ হারানোর সংবাদ সত্যি আমাদেরকে ভীষণ বিচলিত করেছে। উল্লেখ্য, তারও তিন মাস আগে র্যাব-৮ তিনটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা এমনিতেই অপ্রতুল্য। ২০০৪ সালের শুমারি অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৪০টি। এর মধ্যে ২১টি ছিল শাবক। অপরদিকে পুরুষ বাঘের সংখ্যা ছিল ১২১টি এবং স্ত্রী বাঘের সংখ্যা ছিল ২৯৮টি। বছর দশেকের মাথায় সেই সংখ্যা নেমে হয়েছে ১০৬টিতে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের শুমারিতে মাত্র ১০৬টি বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে। সামনের বাঘ শুমারিতে সেই সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে ঠেকে তা জানার অপেক্ষায় আছি এখন।

এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, শুধু সুন্দরবনেই নয়, সারা বিশ্বেই বাঘের সংখ্যা অপ্রতুল্য। মাত্র হাজার দুয়েক ডোরাকাটা বাঘের বাস রয়েছে সারা বিশ্বে। যার কারণেই আইইউসিএন ২০১০ সালে রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী হিসেবে ঘোষণাও করেছে।

আমরা জানি সুন্দরবনের (বাংলাদেশ অংশের) আয়তন ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত অংশের আয়তন ৩৯৮৩ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশের অংশে মাত্র ১০৬টি বাঘের বাস রয়েছে, যা বড়ই বেমানান। এ সংখ্যাটি সুন্দরবনের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে মোটেও সুখকর সংবাদ নয় বরং বড়সড় একটা দুঃসংবাদ। তার ওপর যদি আমরা এভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে হারাতে থাকি, তাহলে ওদের সংখ্যা শূন্যের কোটায় পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়।

যেসব কারণে বাঘের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- বাঘের জন্মহার কমে যাওয়া। তাছাড়া বাঘের শাবককে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বড় হতে হয়। প্রধান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় বাবা বাঘের নজর এড়িয়ে থেকে। ক্ষুধার্ত বাবা বাঘ মা বাঘের কোল থেকে নিজ শাবককে ছিনিয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলে। ফলে জন্ম নেওয়া অনেক শাবক মাস খানেকের মাথায় হারিয়ে যায়। এর সঙ্গে যদি চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য যোগ হয়, তাহলে বিষয়টা কোন পর্যায়ে যেতে পারে, তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বাঘেদের দুঃসময় চলছে এখন। বলা যায় অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে ওরা। অস্তিত্ব সঙ্কটের লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে সুন্দরবনে কোনোমতে বেঁচে আছে স্বল্পসংখ্যক বাঘ। সেই নিদারুণ সময়ে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তের সংবাদ জানতে পেরেছি আমরা। সিদ্ধান্তটি হচ্ছে- পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বিচরণক্ষেত্র নিশ্চিত করতে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। ইতঃপূর্বে এ ধরনের অভয়ারণ্য ছিল মাত্র ২৩ শতাংশ এলাকা নিয়ে। বলা যায়, এটি বাঘ রক্ষার জন্য একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। উদ্যোগটি নেওয়ার ফলে শুধু বাঘই নয়, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও রক্ষা পাবে। হয়তো আগের মতো বাঘের সংখ্যা রাতারাতি বৃদ্ধি না পেলেও বেশ খানিকটা সহায়ক হবে সংখ্যা বৃদ্ধিতে।

এ ক্ষেত্রে প্রথমত নজর রাখতে হবে প্রতিপক্ষ বাবা বাঘের প্রতি। বাবা বাঘ যাতে তার শাবককে খেয়ে ফেলতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে পারলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের বাধা থাকবে না। আরেকটি বিষয়েও নজর দিতে হবে, সেটি হচ্ছে অভয়ারণ্য রক্ষকদের প্রতি। যেন দুস্কৃতকারীর যোগসাজশে তারা বাঘের সর্বনাশ ঘটাতে না পারে। এ দুটি বিষয়ে সজাগ থাকতে পারলে হয়তো আমরা আবার সুন্দরবনে যত্রতত্র বাঘের বিচরণ দেখতে পাব।

আলম শাইন 

বন্যপ্রাণী বিশারদ

alamshine@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads