• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ও বিভিন্ন দেশের কোটা পদ্ধতি

মূলত দেশের অনগ্রসর মানুষদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই কোটা প্রথার প্রচলন

আর্ট : রাকিব

মতামত

চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ও বিভিন্ন দেশের কোটা পদ্ধতি

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ২৩ জুলাই ২০১৮

এপ্রিল মাসের ৮ তারিখ থেকে চারদিন দুর্বার কোটা আন্দোলন গড়ে তোলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যা আজো চলমান। ক্যাম্পাস এখনো অস্থির। প্রায় প্রতিদিনই মারপিট, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

মূলত দেশের অনগ্রসর মানুষদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই কোটা প্রথার প্রচলন। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলেন, তাদের ও তাদের সন্তানদের সুবিধা দেওয়ার জন্য ১৯৭২ সালে প্রথম এই কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়। ক্রমান্বয়ে কোটার পরিধি বেড়েছে। এখন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা এ কোটা সুবিধা ভোগ করছেন। নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, উপজাতি কোটা ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী কোটা ১ শতাংশ।

কোটা সংস্কারের মূল দাবি উত্থাপিত হয় প্রধানত মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান সে বিষয়ে কারো কোনো দ্বিমত নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিলেন গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের তেমন শিক্ষা-দীক্ষা ছিল না। তাই সরকার কোটা ব্যবস্থা চালু করলেও সে ব্যবস্থার সুফল তারা সেভাবে নিতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধা পিতা-মাতার উত্তরাধিকারী তাদের সন্তানরা। সেই হিসেবে তখন এ কোটার প্রয়োজনীয়তা ছিল। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরও সেটা চলমান আছে এবং একই হারে।

একথা ঠিক যে, বিশ্বের অনেক দেশে কোটা পদ্ধতি চালু আছে। ভারতে মোট চার ধরনের কোটা রয়েছে। উপজাতি কোটা, বিভিন্ন জাত ভিত্তিক কোটা, অন্যান্য অনগ্রসরদের জন্য কোটা এবং বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু কোটা। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী সরকারি নিয়োগে কোটার সমষ্টি কোনোক্রমেই মোট শূন্যপদের ৫০ ভাগের বেশি হতে পারবে না। আর এই কোটা পদ্ধতি কোনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থাও নয়। সেখানে উচ্চ আয়ের লোকেরা কখনো কোটার সুবিধা পান না। একবার যিনি কোটার সুবিধা পান, তিনি আর কখনো কোটার সুবিধা পান না। অর্থাৎ পিতা যদি কোটা সুবিধা নিয়েছেন, তার সন্তান কখনো কোটার সুবিধা পাবেন না। কেউ যদি কোটা নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে কোটার সুবিধা পাবেন না। আর যিনি কোটার সাহায্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তিনি কখনো চাকরিতে কোটার সুবিধা পাবেন না।

পাকিস্তানে সরকারি চাকরিক্ষেত্রে সমগ্র দেশ থেকে মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ চাকরি মেধা যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। বাকি ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য সংরক্ষিত। সেটা করা হয় প্রদেশগুলোর আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে, যাতে সব প্রদেশের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকে।

মালয়েশিয়ায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতিগত কোটার মোট ৫৫ শতাংশ সুবিধা পেয়ে থাকেন মালয় জনগোষ্ঠী। উচ্চশিক্ষা, চাকরি, স্বল্পমূল্যে বাসস্থানসহ সব ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ সুবিধা পেয়ে থাকেন তারা। বাকি ৪০ শতাংশ সুবিধা পেয়ে থাকে অন্যান্য জনগোষ্ঠী। তবে চাকরির ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত সুবিধা মিললেও মেধার পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করতে হয়।

চীনে নারীদের জন্য একসময় ২০ শতাংশ কোটা ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সেটা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে প্রতিবন্ধীদের জন্য এখনো দেশটিতে ১ দশমিক ৫ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণ করা হয়।

কানাডায় চাকরির নিয়োগক্ষেত্রে মোট চার ধরনের কোটা আছে- নারী, প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু। তবে সেটা কখনোই মেধার চেয়ে বেশি অর্থাৎ শতকরা ৫০ ভাগ নয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে অনগ্রসর নারীদের জন্য ৪০ এবং শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য ৪ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। বাকি ৫৬ শতাংশ নিয়োগ হয় মেধার ভিত্তিতে।

যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ৮ ভাগ চাকরি প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। দেশটির শ্রম বিভাগ এটাকে কোটা না বলে ‘অক্ষমতার মানদণ্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র এই সিস্টেমটি বাতিল করে এখন প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার প্রদান করে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটা পদ্ধতি চালু থাকলেও কোথাও একটানা ৪০ থেকে ৫০ বছর ধরে কোটা চালু নেই। তাছাড়া দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ ৫৬ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে আর সংখ্যালঘিষ্ঠ পদ ৪৪ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, এটাও কোথাও নেই।

কোটা আন্দোলনকারীরা চেয়েছেন কোটা সংস্কার। তাদের আরো দাবি হলো, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে মেধাতালিকা থেকে শূন্যপদে নিয়োগ দেওয়া। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য অভিন্ন বয়সসীমা। কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় একাধিকবার কোটার সুবিধা ভোগ করা যাবে না।

আমাদের দেশে একই ব্যক্তি কোটার সুবিধা নিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ সবই পেতে পারেন। আবার তার সন্তান-সন্ততিরা পান বংশপরম্পরায়। আর এই কোটার কারণে একজন মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেও চাকরি পান না, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেন না। অথচ তার চেয়ে কম মেধার ছাত্র শুধু কোটার কারণে ভর্তিও হতে পারেন, চাকরিরও সুবিধা পান।

কোটা আন্দোলন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে শুরু হলেও আস্তে আস্তে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর যুক্ত হয় সারা দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। তারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন, সড়ক অবরোধ করতে থাকেন। গত ৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কোটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ৭ মে পর্যন্ত সময় নেন তিনি। সে রাতে কোটা আন্দোলন থেমে যায়। কিন্তু ১০ এপ্রিল সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ছাত্রসমাজ। তারা পরের দিনও আন্দোলন চালিয়ে যান। শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে সিদ্ধান্ত দাবি করেন। গত ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী সংসদে কোটা থাকবে না, প্রতিবন্ধী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য অন্যভাবে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলে ঘোষণা দেন। এ ঘটনার পর ছাত্ররা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে আনন্দমিছিল বের করে।

কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও কোটা বাতিল সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ২৬ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে ২০ মে’র মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারির আলটিমেটাম দেন। জারি না হলে তারা কঠোর আন্দোলনের ঘোষণাও দেন। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধার সন্তান-সন্ততিদের জন্য কোটা থাকার ইঙ্গিত দেন। ফলে পূর্বঘোষণার ধারাবাহিকতায় গত ২৯ জুন থেকে আবার আন্দোলন শুরু করেন ছাত্ররা। ২৯ ও ৩০ জুন এবং ১ জুলাই উপর্যুপরি সাধারণ ছাত্র আর ছাত্রলীগ মুখোমুখি হয়। হামলায় বেশ কয়েকজন ছাত্র আহত হন। এমনকি ছাত্রীরাও লাঞ্ছিত হন। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেছেন, ‘হামলার ঘটনা তার জানা নেই। তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন।’ ২ জুলাই বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন ও যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেনের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন করে শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন। তখনই ছাত্রলীগের ১৫-২০ জন কর্মী তাদের কিল ঘুষি লাথি মেরে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এর আগে ২৯ জুন কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানো হয়। এ সময় ব্যাপক মারধরের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক। তিনি অধ্যাপক জাবেদ আহমেদের পা জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি জানাতে থাকেন। অধ্যাপক নিজের পরিচয় দিয়ে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এ ঘটনায় ইংরেজি বিভাগের ছাত্ররা অপরাজেয় বাংলার সামনে মানববন্ধন করেন। সেখানে যোগ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকও।

ইতোমধ্যে জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও হামলা হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নগ্নপায়ে প্রতিবাদের ডাক দিলেও নিরাপত্তার কারণে তাকে বাইরে যেতে দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে সাধারণ ছাত্ররা খালি পায়ে জোহা চত্বরে সমবেত হয়েছেন। অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম জানিয়েছেন, ‘কোটা সংস্কার নিয়ে কাজ হচ্ছে। কিছু সময় লাগবে।’ সরকারের তরফ থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে আহ্বায়ক করে একটি ৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে রাজধানীর মিরপুর থেকে আটক করেছে ডিবি পুলিশ। পরে তাকে শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক আল নাহিয়ান খান জয়ের দায়ের করা আইসিটি মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। তাকে ইতোমধ্যে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তার মা ছেলের মুক্তির আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।

১২ জুলাই সংসদের ২১তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটার ব্যাপারে আদালতের রায় রয়েছে। কাজেই এ কোটা বাতিল করতে যাওয়া মানে আদালত অবমাননা করা। তবে কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা কোটার ব্যাপারে কাজ করছেন।

কোটা সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশেও আগে হয়েছে। অন্যান্য দেশেও হয়েছে। কাজেই বিষয়টি ঝুলিয়ে না রেখে দ্রুত এর একটি সমাধান আমরা আশা করি। এ ব্যাপারে সরকার ও ছাত্রসমাজ দুপক্ষকেই আন্তরিক হতে হবে। আদালতের রায় থাকলে কীভাবে সমাধান করা যায়, সেটা সরকারকে ভেবে দেখতে হবে আর ছাত্রদেরও হতে হবে ধৈর্যশীল। আমরা চাই সন্ত্রাসমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস, যেন অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠিয়ে অনিদ্রায় রাতযাপন না করেন, যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারেন। ছাত্ররাও যেন পায় একটি নিরাপদ জীবন।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক যুগ্ম সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads