• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
কেমন হবে তিন সিটি নির্বাচন

খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হয়েছে, তা সবাই জানেন কমবেশি

আর্ট : রাকিব

মতামত

কেমন হবে তিন সিটি নির্বাচন

  • প্রকাশিত ২৪ জুলাই ২০১৮

তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে প্রচার-প্রচারণা ততই জমে উঠছে। এই নির্বাচন ঘিরে প্রচারমাধ্যমে প্রতিদিন যেসব খবর আসছে, তাতে এখন পর্যন্ত খুব হতাশ হওয়ার মতো আলামত নেই। তবে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা হচ্ছে প্রধানত বিএনপির পক্ষ থেকে। এসব অভিযোগ এমন গুরুতর নয়, যাতে নির্বাচন দারুণভাবে প্রভাবিত হতে পারে। এগুলোকে খুব বড় করে দেখার প্রয়োজন নেই। ‘পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ’ হলে আখেরে বড় মাছটাই হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। ছোট ছোট বিরক্তির কারণ তৈরি করে প্রতিপক্ষকে ব্যস্ত রেখে দাঁও মেরে দেওয়াও কৌশলপূর্ণ রাজনীতির অংশ হতে পারে বৈকি। তারপরও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বলেন তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন খুলনা ও গাজীপুরের মতোই সুষ্ঠু হবে, তখন অনেকে শঙ্কাবোধ করেন। খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু হয়েছে, তা সবাই জানেন কমবেশি। তিন সিটির আসন্ন ভোট ওই দুই সিটির মতো হলে প্রমাদ গোনার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বাককুশলতা প্রশংসার যোগ্য। তিনি দৃশ্যত যুক্তি দিয়ে কথা বলেন। বিএনপির মুখপাত্র কেন্দ্রীয় অফিসে বসে ওবায়দুল কাদেরের বাক-ব্যাটিং মোকাবেলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে সিলেটের আরিফুল হক চৌধুরী ও বিএনপির স্থানীয় নেতারা এ ক্ষেত্রে সাহসী ভূমিকা রাখছেন। প্রতিদিন আমরা সে রকম খবরই পাচ্ছি। কাদের সাহেব বলেছেন যে, যারা নির্বাচনের আগেই হেরে যায়, তাদের দিয়ে কী হবে! কথাটি খাঁটির চেয়েও খাঁটি। নির্বাচন ভালো হবে না, ইঞ্জিনিয়ারিং হবে, ভোটাররা ঠিকমতো ভোট দিতে পারবেন না— এ ধরনের কথা অবিরত বলতে থাকলে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মনোবল ভেঙে যাওয়াই স্বাভাবিক। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা সব সময়েই বলেন, খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে বা তাকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। কিন্তু এ কথা বলেন না যে, ইলেকশনে অনিয়মের চেষ্টা করা হলে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হলে বিএনপি সেটা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে। বরং কেন্দ্রীয় নেতাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রায়ই দলটির অক্ষমতার সুর ফুটে ওঠে, যা কর্মীদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তবে অনস্বীকার্য, সিলেটের বিএনপির মেয়র প্রার্থী ও অন্য নেতারা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আরিফুল হক বলেছেন, জীবন দিয়ে হলেও নির্বাচনে কারচুপি প্রতিহত করা হবে। তারা জনগণের কাছে এই বার্তাই দিয়ে যাচ্ছেন যে, সিলেট গাজীপুরও নয়, খুলনাও নয়। এখানে কারচুপি করে পার পাওয়া যাবে না। বাস্তবে তারা কী করতে পারবেন বা পারবেন না, সেটা ভিন্ন কথা। এখন তারা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কর্মীদের মনোবল ধরে রাখার জরুরি কাজটি করে যাচ্ছেন বলেই মনে হয়। রাজশাহীর মেয়র প্রার্থী বিএনপির মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘন ও পুলিশি হয়রানির অভিযোগ তুললেও সাহসের সঙ্গে সব বাধা মোকাবেলা করার সঙ্কল্প ব্যক্ত করছেন। তিনি বলছেন, যেখানেই বাধা আসবে সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। অনিয়ম সহ্য করা হবে না। সরকারপন্থি দুয়েকটি পত্রিকায় বিএনপি প্রার্থীদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর চেপে রাখবার কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। এটি বড় কোনো সমস্যা নয়।

পর্যবেক্ষক মহলের অনেকেই বলছেন, আসলে বিএনপির বড় সমস্যা হচ্ছে কেন্দ্রের হঠকারী নীতি-কৌশল এবং দলটির অস্বাভাবিক সাংগঠনিক দুর্বলতা। বরিশাল সিটির দৃশ্যমান পরিবেশও নৈরাশ্যজনক নয়। বিএনপির প্রার্থী ক্রমাগত দাবি করে চলেছেন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়নের। আওয়ামী লীগের প্রার্থীও কৌশলে সেনা মোতায়েনের বিষয়ে তার অনাপত্তির কথা বলছেন। তার বক্তব্য; নির্বাচন কমিশন যদি সেনা মোতায়েনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে তাহলে তার কোনো আপত্তি নেই। বাহবা পাওয়ার জন্য তার এই অবস্থান চমৎকার।

ইলেকশনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের যখন দাবি করা হয়, তখন দেশের রাজনৈতিক সমাজের দুর্বলতা যেমন প্রকাশ পায়, তেমনি বেসামরিক প্রশাসনের প্রতি রাজনৈতিক সমাজের আস্থাহীনতার বিষয়টি প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। পুলিশ প্রশাসনের জন্যও এটি সম্মানজনক নয়। খুলনা ও গাজীপুরে সেনা মোতায়েন করা হয়নি বলে বিএনপি প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে, এমন কথা হলফ করে কেউ বলতে পারবেন না। গাজীপুরে একা হাসান সরকার লড়ে গেছেন শেষপর্যন্ত। আদালতের নির্দেশে যখন ইলেকশন স্থগিত করা হয়েছিল তখনো হাসান সরকার বলেছিলেন, গাজীপুর খুলনা নয়। রাজধানীর উপকণ্ঠের এই মহানগরে অনিয়ম করে পার পাওয়া সহজ নয়। প্রতিরোধ করা হবে। নির্বাচনের দিনও তিনি অনিয়ম দেখে আগেভাগেই সরে দাঁড়াননি। এটা ঠিক যে, গাজীপুরে বেসামরিক প্রশাসন এবং পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তার চেয়েও কঠিন সত্য হচ্ছে, দলের সাংগঠনিক দুর্বলতা। বড় পত্রিকাগুলোতে প্রকৃত পরিস্থিতির খবর ঠিকমতো ছাপা না হলেও অনেক অনলাইন পত্রিকায় সরেজমিন রিপোর্ট ও নির্বাচন-পরবর্তী বিশ্লেষণ বেরিয়েছে, যেখানে মাঠ পর্যায়ে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। কার্যত পুলিশি হয়রানির কথা বলে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা গা বাঁচিয়ে চলেছেন আগাগোড়া। ফলে হাসান উদ্দিন সরকার আশানুরূপ ফল পাননি।

অবশ্য এও সত্য যে, বিএনপির পাঁচ বছর আগের হঠকারী নীতি-কৌশলের ফল স্থানীয় নেতাদের ভোগ করতে হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, অতীত খুব সহজে অতীত হয়ে যায় না। ভুলের খেসারত দিতে হয় বহুদিন পর্যন্ত। পুরনো হলেও কথাগুলো আবার বলা দরকার। চৌদ্দ সালের নির্বাচন বর্জন করা ছিল বিএনপির জন্য একটি বড় ভুল। নির্বাচন প্রতিহত করার নামে দিনের পর দিন অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে ঘরে বসে বিএনপি ফায়দা হাসিল করতে চেয়েছে। অবরোধ কর্মসূচির সময় বাসে-ট্রেনে আগুন দেওয়া হয়েছে, বোমা হামলা হয়েছে। পুড়ে মানুষ মরেছে। আর বিএনপি কর্মীদের নামে-বেনামে মামলা হয়েছে বেশুমার। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতাদেরও হুকুমের আসামি করা হয়েছে। অনেকে তখনই গ্রেফতার হয়েছেন। বিএনপি নেতারা সেন্ট্রাল অফিসে বসে বলে গেছেন যে, বাসে আগুন দিচ্ছে সরকারের লোকেরা, বিএনপি নয়। বাসে ট্রেনে আগুন সন্ত্রাস যারাই করে থাকুক না কেন, দায় তো তাদেরই, যারা অবরোধ দিয়েছে। এটা তো খুব স্বাভাবিক যুক্তির কথা। বিএনপির নেতৃত্ব যখন জানতেন যে, এই আগুন সন্ত্রাস অন্য কোনো মহল থেকে হচ্ছে এবং দেশের কোথাও বিএনপির কর্মীরা মাঠে নেমে স্বীকৃত পন্থায় অবরোধ করতে পারছে না, তখন নেতৃত্বের এটা বোঝা খুব দরকার ছিল যে, অবরোধ ঘুড়ির সুতো কেটে গেছে। অবরোধ যখন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, তখন সেই অকার্যকর কর্মসূচি প্রত্যাহার করে আগুন সন্ত্রাসের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া জরুরি ছিল। সেদিন এই কাজটি করা হলে দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের গণহারে আইনের জালে পড়তে হতো না, তাদের হয়রানির শিকার হতে হতো না। সেই ভুলের খেসারত কর্মীদের দিতে তো হচ্ছেই, উপরন্তু পাঁচ বছরের মধ্যে দল গোছানোর কাজটিও তারা সম্পন্ন করতে পারেননি। অন্তত গাজীপুরে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।

এখনো বিএনপি ঠিক পথে আছে, তেমনটি বলা যায় না। বেগম জিয়া কারাগারে। দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দেশের বাইরে। জেলে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানের নেওয়াজ শরীফের মতো তিনি সহসা দেশে আসবেন, এমন কোনো আলামত নেই। পার্লামেন্টেও বিএনপি নেই। সংবিধান সংশোধন হয়ে গেছে অনেক আগেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইন অতীত হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় বহাল সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে- এটাই শাসনতন্ত্রের কথা। পার্লামেন্টের বাইরে থেকে আওয়াজ দিয়ে শাসনতন্ত্র সংশোধন করা যায় না। এগুলো কঠিন বাস্তবতা। বিএনপির নেতৃত্ব এই বাস্তবতা বুঝতে পারছেন না, তা হয়তো নয়। কিন্তু বুঝেও বেবুঝের মতো কাজ করলে সেই বুঝতে পারা অর্থহীন।

বিএনপির নেতৃত্ব সামনের তিন সিটি নির্বাচনে সব বাধা অতিক্রম করে জিতে তার জনসমর্থন প্রমাণ করতে চায়, নাকি হেরে এটা প্রমাণ করতে চায় যে, এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়? এ খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আত্মহত্যা করে প্রমাণ করা যায় যে, জীবন ওই ব্যক্তিকে সুখ দেয়নি। কিন্তু এটা প্রমাণ করে আত্মঘাতীর নিজের কোনো লাভ হয় না। কেননা, জীবন তাকে ফিরিয়ে এনে সুখময় নতুন জীবন উপহার দেয় না। এই সরকার খুব খারাপ এটা প্রমাণ করার চাইতে বিএনপির যে জনসমর্থন রয়েছে, সেটা প্রমাণ করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে পর্যবেক্ষক মহল।

বিএনপি বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। মনে হয় সে প্রক্রিয়া অনেকটা এগিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঐক্যটা কি নির্বাচনমুখী নাকি আন্দোলনমুখী। আন্দোলন করে এই সরকারের পতন ঘটিয়ে সংবিধান পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ইলেকশনের কথা চিন্তা করা যেতেই পারে। কিন্তু সেটা হবে ইউটোপিয়া। কারণ হু. মু এরশাদের সরকার আর আওয়ামী লীগের সরকার এক জিনিস নয়। নব্বইয়ের অভিজ্ঞতা এই সরকারের বেলায় কাজ করবে না। কেননা, এরশাদের কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল না। সেনাবাহিনীর সমর্থনই তাকে নয় বছর টিকিয়ে রেখেছিল। চারপাশে মোসাহেবরা ছিল স্বৈরাচারের গুণগান করার জন্য। ফলে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী এরশাদের পতন ঘটানো সম্ভবপর হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থা এরশাদের মতো নয়। এই দলের সাংগঠনিক ভিত্তি বিএনপির চাইতে বেশি বৈ কম নয়। এই বাস্তবতায় নির্বাচন পরিহার করে আন্দোলনমুখী ঐক্য খুব ফলদায়ক হবে- এমনটি আশা করা যায় না। কাজেই এখন বিএনপির কর্তব্য তিন সিটি নির্বাচনের পরীক্ষায় কণ্টকিত পথ পেরিয়ে হলেও উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা।

দেশের জনসাধারণ সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান। শাসক দলও বোধহয় চাইবে না যে তিন সিটি নির্বাচন খুলনা ও গাজীপুরের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হোক। তবে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনেরও মেরুদণ্ড শক্ত করতে হবে। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা কমবেশি সবসময় থাকে। গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক থেকে তাদের গুরুদায়িত্ব পালন করে যেতে হবে।

ফাইজুস সালেহীন

কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads