• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯
বিমসটেক : আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন আশা ও সংশয়

ব্যাংকক ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৯৭ সালে বিমসটেক গঠিত হয়

সংগৃহীত ছবি

মতামত

বিমসটেক : আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন আশা ও সংশয়

  • প্রকাশিত ০৩ অক্টোবর ২০১৮

মীর মোশাররেফ হোসেন পাকবীর

বর্তমান পৃথিবী বিশ্বায়নের পথে ধাবিত হচ্ছে। বাণিজ্য, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব ক্ষেত্রই এখন এই ধারণায় পরিচালিত। বাইরের অংশীদারদের প্রভাব বলয়ের বাইরে থেকে এখন আর কোনো প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। তাই আঞ্চলিক সহযোগিতা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন’ বা বিমসটেক দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাতটি দেশের জন্য এমনই একটি ফোরাম। ২০১৬ সালের সার্ক সম্মেলন ভারত ও পাকিস্তানের কলহের কারণে বাতিল হয়ে যাওয়ার দরুন সাম্প্রতিক সময়ে বিমসটেক একটি সহযোগিতা সংস্থা হিসেবে বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বেশকিছু সর্বজনীন স্বার্থ থাকার কারণে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র স্থাপনের মাধ্যমে ব্যাপক উপকৃত হতে পারে।

ব্যাংকক ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৯৭ সালে বিমসটেক গঠিত হয়।  এর সাত সদস্যের মধ্যে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার এবং মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত।

এই আঞ্চলিক গোষ্ঠীটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন রচনা করে। সার্ক ও আসিয়ান সদস্যদের মধ্যে আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতার একটি মঞ্চ বিমসটেকের মাধ্যমে উদ্ভব হয়। প্রায় দেড় বিলিয়ন মানুষ বিমসটেক এলাকায় বসবাস করে, যা বিশ্ব জনগোষ্ঠীর প্রায় ২২ শতাংশ। এই অঞ্চলের সম্মিলিত জিডিপি প্রায় ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন যা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। গত পাঁচ বছরে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলো গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়।

বিমসটেক আসলে একটি সেক্টরভিত্তিক সহযোগিতা সংগঠন এবং এদিক থেকে এটি অন্য অনেক আঞ্চলিক গোষ্ঠীর তুলনায় ব্যতিক্রম। প্রথম দিকে এটি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, প্রযুক্তি, জ্বালানি, পরিবহন, পর্যটন ও মৎস্যসম্পদ— এই ছয়টি খাত নিয়ে কাজ শুরু করে। পরবর্তী সময়ে আরো ৯টি খাতের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এর পরিধি বিস্তৃত হয়। এ খাতগুলো হলো কৃষি, জনস্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, সন্ত্রাস বিরোধ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং জলবায়ু পরিবর্তন। এটি সমুদ্র অর্থনীতি ও পার্বত্য অর্থনীতির ওপরও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

২০১৮ সালের ৩০-৩১ আগস্ট নেপালের কাঠমান্ডুতে চতুর্থ বিমসটেক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা এতে অংশগ্রহণ করেন। কাঠমান্ডু ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ সম্মেলনটি শেষ হয়। এতে এই অঞ্চলের সমষ্টিগত উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক একীভূতকরণের নিমিত্তে বহুমাত্রিক সংযোগকে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে গুরুত্বারোপ করা হয়। এতে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে তুলে ধরা হয়। এই ঘোষণার মাধ্যমে বিমসটেক এ অঞ্চলে বিভিন্ন কারিগরি ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে বিমসটেক সচিবালয়ের কার্যকারিতা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়। বিমসটেক গ্রিড আন্তঃসংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বিদ্যুৎশক্তি সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষর করে।

বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নেতারা নিশ্চিত করেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শুধু সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসী সংগঠন ও নেটওয়ার্ককেই নয়; বরং সেসব রাষ্ট্র বা অরাষ্ট্রীয় সংগঠন এবং ব্যক্তি যারা সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহিত, সমর্থন বা অর্থায়ন করে অথবা সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে নিরাপত্তা প্রদান করে এবং ভুলভাবে সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর চিন্তাধারাকে প্রশংসা করে, তাদেরকেও চিহ্নিত ও দায়ী করা হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করার পরেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুটি কেন আলোচনার টেবিলে উঠল না, তা নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা আগ্রহী হয়ে ওঠে। এর জবাবে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ কুমার গ্যায়ালি বলেন, বিমসটেক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সর্বজনীন স্বার্থ ও উদ্বেগ নিয়ে কাজ করা এবং তাই কোনো একটি বিশেষ দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা কোনো দুটি দেশের মধ্যকার বিরোধ সামিটে প্রবেশ করেনি। কিন্তু এটি ছিল একটি জ্বলন্ত সমস্যা উপেক্ষা করার চরম দৃষ্টান্ত এবং একে একজন সদস্যের বা সর্বজনীন স্বার্থ রক্ষা না করার পন্থা হিসেবে দেখা যেতে পারে।

রাজনৈতিক শান্তি ছাড়া আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর সফল হওয়া খুবই কঠিন। এক্ষেত্রে শুধু বাণিজ্য ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোই যথেষ্ট নয়। আঞ্চলিক সহযোগিতা বজায় রাখতে মানবিক প্রেক্ষাপট অত্যাবশ্যকীয়। সীমান্তে অস্ত্রের ব্যবহার, ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে সক্ষম অস্ত্রের ব্যবহার বা দূষণক্ষম অস্ত্রের ব্যবহার আঞ্চলিক সহযোগীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ না করলে সার্কের মতোই বিমসটেকও ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হতে পারে।

ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত বিমসটেক তার লক্ষ্যগুলো পূরণে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে এবং এর কিছু কারণও রয়েছে। যেমন- বিমসটেক সদস্যদের বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক ফোরামের সদস্যপদ গ্রহণ করে বিভিন্ন স্তরে সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, সংযোগের অভাব, আন্তঃআঞ্চলিক বিনিয়োগের স্বল্প প্রবৃদ্ধি, পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব যা খরচ ও সময় বাড়িয়ে বাণিজ্যের জন্য বাধা সৃষ্টি করে ইত্যাদি। তদুপরি আঞ্চলিক ফোরামগুলোতে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ অভ্যন্তরীণ নীতির সঙ্গে প্রচুর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করতে পারে। যার ফলে সামগ্রিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য এসব ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সমন্বয় সাধন করা অতীব জরুরি।

আঞ্চলিক বাণিজ্য অথবা অর্থনীতিতে নতুন সাফল্য যোগ করার জন্য বিমসটেক সদস্যদের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। বিশেষত ভারতের প্রভাবের কারণে এ ধরনের চুক্তি এখনো কার্যকর হয়নি, যদিও কিছু ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক অগ্রাধিকারভিত্তিক কিছু নিয়ম কার্যকর হয়ে থাকে কিন্তু কঠিন আইন ও মানদণ্ডের মাধ্যমে নানাবিধ বাধা তৈরি করা হয়। সদস্য দেশগুলোর মুদ্রার মূল্যায়ন অত্যন্ত কাছাকাছি হওয়ার কারণে বিমসটেকেরও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো অনেক অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সম্ভাবনা রয়েছে। তার ওপর, যদি এই সাতটি দেশের মধ্যে নাগরিকদের ভিসাবিহীন চলাচল নিশ্চিত করা যায়, তবে সাধারণ মানুষও এই সমন্বিত আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি আরো গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারবে। এখানে সাংস্কৃতিকভাবে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যথেষ্ট মিল থাকার কারণে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার সম্পর্ক আরো দৃঢ় করা সম্ভব, যদি সবার সৎ অভিপ্রায় থাকে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা তার দূরদর্শী নেতৃত্বেরই প্রতিফলন। আজকের বিশ্বে যখন বিভিন্ন অর্থনীতির কার্যকারিতা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল তখন বাংলাদেশকে অবশ্যই শক্ত দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্র স্থাপন করতে হবে। এজন্য আমাদের সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ শুরু করতে হবে।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মোহাম্মদী স্টক মার্কেট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads